গোপালগঞ্জে ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার যে চেষ্টা হয়েছিল, সেই বোমাটি খুঁজে পাওয়া যায় যার কারণে, তিনি একজন সাধারণ চা বিক্রেতা।
২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়। ৪০ কেজি ওজনের আরও একটি বোমা পোঁতা হয় হয় তখন।
লুৎফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের উত্তর পাশে হেলিপ্যাডের কাছে পোঁতা হয় বড় বোমাটি। জনসভায় যোগ দিতে হেলিকপ্টারে করে আসা বঙ্গবন্ধু কন্যার নামার কথা ছিল সেখানে। আর ছোট বোমাটি পোতা হয় জনসভাস্থলে।
ঘটনার আগের সকালে চায়ের দোকানি বদিউজ্জামান সরদার ঘটনাক্রমে বোমার তারটি খুঁজে পান। এর সূত্র ধরেই এই বোমাটি এবং পরে আরও একটি বোমা পাওয়া যায়।
বোমাটি যখন সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল খুঁজে যায়, তখন তারা এর শক্তি সম্পর্কে বুঝতে পারে। এটি বিস্ফোরিত হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে, এই আশঙ্কায় দুই কিলোমিটারের মতো এলাকা থেকে সরানো হয় জনসাধারণকে।
বাবা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ছয় বছর পর ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর এখন পর্যন্ত ১৯ বার হত্যাচেষ্টার অভিযোগ করছে তার দল। এসব ঘটনায় অন্তত ১৩টি মামলার তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে রায় হয়েছে ছয়টির। সাতটি এখনও বিচারাধীন।
আর যে ছয়টি মামলায় রায় হয়েছে, তার মধ্যে কেবল কোটালীপাড়ায় বোমা হামলা মামলার নিষ্পত্তি হলো হাইকোর্টে। এখন বাকি আপিলের মীমাংসা।
এই মামলায় ১০ জনের প্রাণদণ্ডের আদেশ এসেছিল বিচারিক আদালত থেকে। হাইকোর্ট রায় বহাল রাখার দিন সেই দোকানের পাশে বসে বদি স্মৃতিচারণ করেন নিউজবাংলার কাছে।
তিনি বলেন, ‘সকালবেলা ফজরের নামাজের পড়ে আমি দুকান খলি। দুকান খুইলা মালামাল বাইর কইরা কলসি নিয়া পানি আনতে যাই।
এই পুকুর থেকে পানি আনতে গিয়েই বোমার তার খুঁজে পান বদিউজ্জামান সরকার‘আমার দুকানের দক্ষিণখানে আমার ঘাট আছিল। তিনখান গাছ দিয়া একটা ঘাট আছিল। সেই ঘাটে পানি আনতে গেলে একটা তার দেখতে পাই।
‘তারটি ধরলে দেখা গেল, তিনটা গাছের নিচ দিয়া নিছে তারটা। একটা মাথা গেছে দক্ষিণ দিয়া, এক মাথা গেছে উত্তর দিকে।
‘দক্ষিণ সাইডের অংশডা টাইনা আমি তার গুছাইয়া ঘাটের পারে রাখলাম। উত্তর মাথার দিকে দেখলাম দোকানের পিছন দিয়া রাস্তার দিকে ওপরে উঠছে।
‘পরবর্তীতে আমি ওইডা থুইয়া দোকানে পানি নিয়া চইলা আইলাম কলসি নিয়া।’
এরপর কোটালীপাড়া পৌরসভার মেয়র কামাল হোসেন ঘটনাস্থলে যান।
শেখ হাসিনার হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য যে হেলিপ্যাড তৈরি করা হচ্ছিল, সেখান থেকে জনসভাস্থলে যেতে রাস্তার কাজ তদারক করছিলেন তিনি।
বদিউজ্জামান বলেন, ‘মেয়র মহোদয় আইলেন, কামাল সাব, তারে দেহাইলাম।…সে আমারে বলল, ভাডি (ভাই) এইডা থাকুক, কেউ যেন না ধরে। আমি পার্টি অফিসে যাইয়া থানায় ফোন করব আনে।’
এর কিছুক্ষণ পরে পুলিশ এসে বদিউজ্জামানের দোকান বন্ধ করতে বলে।
তিনি বলেন, ‘থানার থেইক্যা যে দারোগা সাব আসল, দুইজন লোক নিয়া, তার ধইরা টানাটানি করল। তার ছিইড়া গেল। দক্ষিণ দিকের যে অংশডা, ওই অংশডা টানাটানি করলে আর আসে না।
‘একটা গোজার পেচাইয়া দক্ষিণ মাথাত যাইয়া একটা তাল গাছের গোড়া পানির মইদ্যে ডুবাইয়া রাখছিল। পরে তারটা উটাইয়া আমার দোকানে থুইল।
‘আমারে কইল, ‘‘তুমার দোকানে ইয়া থাক, দোকান খোলার দরকার নাই। বেচাকেনার দরকার নাই।‘”
বদিউজ্জামান বলেন, ‘পুলিশ পিছন দিয়া খুঁজতে খুঁজতে যেই রোডের দিকে ওপরে উঠল, দেখল একটা পলিথিন। তহন লোকজন সরাইয়া দিয়া পুলিশ চতুর্দিকে ইয়ে করল।’
পরে কোটালীপাড়া থানা পুলিশ সন্দেহজনক ঘটনাটি জানায় সদরদপ্তরে। সেখান থেকে জানানো হয় সরকারকে। আর সেনাবাহিনীর বোমা নিষ্ক্রিয় দল যায় ঘটনাস্থলে।
বদিউজ্জামান বলেন, ‘রাত্রেবেলা আর্মির একটা টিম আসল। তারা আইসা ই-টি করল, উঠাইল।
কোটালীপাড়ার এই কলেজ মাঠে শেখ হাসিনার জনসভাকে লক্ষ্য করে ৭৬ ও ৪০ কেজির দুটি বোমা পোতা হয়‘যহনই আর্মি উঠাইতে গেল, তহন মিটার দিয়া মাপ দিছে, যেডুকুই আসল, বেশি উইঠা গেল। তহন আর্মি ভয় পাইয়া গেল। অত বড় জিনিস এই জায়গায় কী আছে।
‘লোকজন সরাইয়া দিয়া রাইতের বেলায় উঠাইল, ৭২ কেজির (আসলে ৭৬ কেজির) বোমা। পরবর্তীতে আরেকটা পাওয়া গেল। হ্যালিপেডের পূর্ব সাইডে, আমি এই জায়গায় ছিলাম না, থানায় ছিলাম।’
রায় ঘোষণার খবরে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বদিউজ্জামান বলেন, ‘রায় ঘোষণা হইছে, খুশি লাগতাছে। ভালো লাগতাছে। যারা নিরপেক্ষ, তারা মুক্তি পাক, যারা এই কাজ করছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। ভবিষ্যতে কোনো দিন যেন কেউ কিছু করতে না পারে।’
রায়ের খুশিতে এলাকায় মিছিল, মিষ্টি বিতরণ
এই মামলায় ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট রায় হয়েছিল বিচারিক আদালতে। সাড়ে তিন বছর পর রায় এল হাইকোর্ট থেকে।
এখন আপিল বিভাগে আবেদন করার সুযোগ পাবেন দণ্ডিতরা। সেই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউয়ের সুযোগ আছে। সবশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আইনি সুযোগও পাবেন সাজাপ্রাপ্তরা।
কোটালীপাড়াবাসী অবশ্য অত কিছু নিয়ে ভাবছেন না। রায় হয়েছে, তাতেই খুশি তারা।
হাইকোর্টের আদেশ প্রচার হওয়ার পর পর আনন্দ মিছিল হয়েছে এলাকায়। হয়েছে মিষ্টি বিতরণ।
উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল কৃষ্ণ বিশ্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই রায়ের কারণে কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রী তার নিজ এলাকায় কোনো প্রকারের সিকিউরিটি ছাড়াই চলে ফিরে বেড়াতেন। কিন্তু এই কোটালীপাড়ার কিছু বিপথগামী লোক তাকে হত্যার চেষ্টা করে যেটা আমাদের জন্য ছিল লজ্জাজনক একটি ঘটনা।
‘আজকের রায়ে আমরা গোপালগঞ্জবাসী তথা সারা দেশের মানুষ অনেক আনন্দিত।’
যে সমাবেশে হামলার জন্য বোমা দুটি পোঁতা হয়েছিল, সেটি হওয়ার কথা ছিল শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ সরকারি কলেজ মাঠে।
কলেজ সংসদের তৎকালীন ক্রীড়া সম্পাদক জুয়েল সরদার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল তার উপযুক্ত বিচার হয়েছে। আমরা অনেক অনেক খুশি।’
তিনি বলেন, ‘এই ঘটনার দিন সেনাবাহিনী মাইকিং করে ঘটনাস্থল থেকে চারপাশে দুই কিলোমিটার পর্যন্ত জনশূন্য করে রেখেছিল। তাদের ধারণা ছিল, এই বোমা এতটা শক্তিশালী যে এটি ব্লাস্ট হলে দুই কিলোমিটারের মধ্যে যা আছে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। সেদিনের সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে ওঠে।’