বরগুনার তালতলীতে হস্তান্তরের ১২ দিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর ধসে পড়ার ঘটনায় নির্মাণকাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, যার সত্যতা পাওয়া গেছে নিউজবাংলার অনুসন্ধানেও।
তবে এই অনিয়মের দায়ভার নিতে রাজি নন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কেউই।
শুক্রবার তালতলী উপজেলার বেহালা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া উর্মিলা রানীর ঘরের ভেঙে যাওয়া দেয়াল থেকে ইটগুলো আলাদা করছেন কিছু শ্রমিক। সেই ইট ফের গেঁথে নতুন করে দেয়াল তোলার প্রস্তুতি চলছে।
এই ইটগুলো ভালো না বলে দাবি উর্মিলার। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ইটের মান নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে ধমক দিয়ে বলা হয়েছে, ‘মাগনা ঘর পাইছ আবার এত কথা কও ক্যা।’
দেয়াল গাঁথুনির সময়ও গভীরতা ও মাটি ভরাট নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন বলে জানান উর্মিলা।
- আরও পড়ুন: ১২ দিনেই ধসে গেল উপহারের ঘরের দেয়াল
উর্মিলা রানীর ধসে যাওয়া ঘরের দেয়াল নতুন করে নির্মাণ করছেন শ্রমিকরা। ছবি: নিউজবাংলা
প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় যার জমি আছে, ঘর নেই, তার জমিতে ঘর করে দিতে বরগুনার তালতলী উপজেলায় ১৭ কোটি ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
এ বরাদ্দ থেকে উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে ১০০টি ঘর নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। কাজের তদারকির দায়িত্ব ছিল তালতলী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রুনু বেগমের।
উর্মিলার এই ঘরটি গত ২৩ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর দুবার ধসে পড়ে ঘরটি। দ্বিতীয় দফায় বুধবার সকালে দেয়াল ভেঙে পড়লে অল্পের জন্য বেঁচে যান ৭১ বছর বয়সী উর্মিলা।
এ ঘটনার পর থেকে নতুন ঘর নিয়ে শঙ্কিত অন্যরাও। তাদের অভিযোগ, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ও দায়সারা কাজের ফলে ঘরগুলো মজবুত হয়নি। যেকোনো মুহূর্তেই ভেঙে পড়তে পারে এগুলো, ঘটতে পারে হতাহতের ঘটনা।
উপজেলার ছোটবগী ইউনিয়নের বথীপাড়ায় ২০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগেরই অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে, শুধু টিনের ছাউনি দেয়া বাকি।
ওই এলাকার আশপাশের কোথাও সুফলভোগী কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে আবদুল খালেককে নিয়ে গাঁথুনির গভীরতা খুঁড়ে দেখেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক।
ঘরের গাঁথুনির গভীরতা যাচাইয়ে খুঁড়ে দেখা হলো মাটি। ছবি: নিউজবাংলা
দেখা যায়, কোনো কোনো ঘরের মাটির নিচে গাঁথুনি ছাড়াই সমতল থেকে দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। আবার কিছু ঘরের গাঁথুনি দেয়া হলেও তার গভীরতা এক ফুটের কম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানকার এক নির্মাণশ্রমিক বলেন, ‘কমপক্ষে তিন ফুট গভীরতায় ইটের গাঁথুনি থাকার কথা। এখানে এক ফুটেরও কম গভীর থেকে ইটের গাঁথুনি দিয়ে দেয়াল তোলা হয়েছে। একইভাবে প্রতিটি ঘরেরই মাটির নিচে এমন গাঁথুনি।
এরই মধ্যে দেখা হলো সেখানকার এক সুফলভোগী আবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ঘরগুলোতে নিম্নমানের ইট ও কংক্রিটের ব্যবহারের বিষয়ে শুরু থেকেই তারা মাঠে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের অভিযোগ আমলে না নিয়ে বলা হয়েছে, ‘আমাদের কাজ আমাদের করতে দেন।’
আবুল জানান, দেয়ালের গাঁথুনির গভীরতা এত কম যে, সামান্য ঝড়েই এসব ঘর ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে।
প্রতিটি ঘরেরই এক ফুটেরও কম গভীর থেকে ইটের গাঁথুনি। ছবি: নিউজবাংলা
নাম না প্রকাশ করার শর্তে আরেক সুফলভোগী নিউজবাংলাকে জানান, নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের জন্য তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ইট-বালু-সিমেন্ট আনার জন্য আমাগো কাছ দিয়া হেরা ভাড়া টাহা নেছে…সবাই কমবেশি দেছে...১০ হাজারের কম হবে না।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে একমত কড়ইবাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কৃষ্ণকান্ত মজুমদার।
তিনি বলেন, ‘এই ঘরগুলোর নির্মাণকাজ তদারকি করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান। এ ছাড়াও ঘরের নির্মাণসামগ্রী ক্রয় ও নির্মাণ ঠিকাদার নিয়োগ করে ঘর নির্মাণের কাজটি করেছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রুনু বেগম।
‘ঘরের নির্মাণের জন্য নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার কথা বলেছি। কিন্তু ইউএনও ও পিআইও আমাদের বলেছেন, বরাদ্দ অনুসারেই ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।’
এ নিয়ে জানতে ঠিকাদার নয়ন মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি পরিবহন খরচ সুফলভোগীদের কাছ থেকে নেয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘ঘরপ্রতি আমাদের যে পরিমাণ খরচা ধরা হয়েছে তাতে লাভ তো হবেই না, বরং গচ্চা যাবে। তাই আমরা সচ্ছলদের কাছ থেকে পরিবহন বাবদ কিছু খরচা নিয়েছি।’
গাঁথুনির বিষয়ে জানতে চাইলে নয়ন বলেন, ইউএনও ও পিআইও যেভাবে বলেছেন, তিনি সেভাবেই কাজ করেছেন।
বরগুনার তালতলীতে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর। ছবি: নিউজবাংলা
তবে কোনো দায় নিতে রাজি হননি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রুনু বেগম। এ বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি।
রুনু বলেন, ‘এ বিষয়ে যা তথ্য জানা দরকার স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।’
শুক্রবার দুপুরে উর্মিলার ভেঙে যাওয়া ঘর পরিদর্শনে যান তালতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান। তিনি জানান, নিজেই এবার নির্মাণকাজ তদারকি করছেন।
সে সময় নির্মাণকাজ নিয়ে স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, ‘আমরা ঘরগুলো নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করেছি। ঠিকাদার কিছু ঘরে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়াও কিছু ঘরের কাজ ঠিকভাবে করেননি। আমরা ওই সব ঘর পুনরায় নির্মাণ করে দেব।’
তিনি আরও বলেন, অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে প্রকল্প কর্মকর্তাকে শিগগিরই তলব করা হবে।