গাজীপুরের শ্রীপুরের সারাহ রিসোর্টে বিষাক্ত মদ সরবরাহ ও মদ্যপানে তিনজন মারা যাওয়ার ঘটনায় মো. জাহিদ মৃধা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টার দিকে রাজধানী ঢাকার নিকুঞ্জ এলাকার এক বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে গাজীপুরের পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার এ কে এম জহিরুল ইসলাম এ সব তথ্য জানান।
এ সময় গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম, জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ওসি নিতাই চন্দ্র সরকারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকের পিআর প্রতিষ্ঠান ফোরথটপিআরের ৪৩ জন কর্মী গত ২৮ জানুয়ারি অবকাশ যাপনের জন্য গিয়েছিলেন গাজীপুরের সারাহ রিসোর্টে। দুই রাত সেখানে অবস্থানের পর শনিবার তারা ঢাকা ফেরেন।
এর মধ্যে ঢাকায় ফিরে অসুস্থ হয়ে মারা যান তিনজন। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন অন্তত আট জন।
তবে এতজন কর্মীর অবকাশ যাপনে যাওয়া, তিন জনের অসুস্থ হয়ে মৃত্যু ও বাকিদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নিয়ে এশিয়াটিকের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল কেউ কথা বলেননি।
পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ৪২ বছর বয়সী জাহিদ রিসোর্টে কোমল পানীয়ের পাশাপাশি এলকোহল সরবরাহ করতেন। নিকুঞ্জ এলাকার আত্মীয়ের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার জহিরুল জানান, গত ২৮ জানুয়ারি এশিয়াটিক মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেডের আওতাধীন ফোরথটপিআর নামক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ৪৩ জনের একটি দল বেড়াতে আসে সারাহ রিসোর্টে। তারা ৩০ জানুয়ারি দুপুরে ঢাকা ফেরার পথে অন্তত ১৬ জন শারীরিকভাবে অসুস্থতা বোধ করলে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন।
তাদের মধ্যে ওই রাতেই কাউছার আহম্মেদ, পরদিন ৩১ জানুয়ারি সকালে সিহাব জহির এবং ১ ফেব্রুয়ারি সকালে এ কে এম শরিফ জামান ভূঁইয়া মৃত্যুবরণ করেন। এ বিষয়ে সারাহ রিসোর্ট এবং এশিয়াটিক কর্তৃপক্ষের নীরবতা বা গোপনীয় মনোভাবের কারণে গাজীপুর জেলা পুলিশের তদন্ত নামতে কিছুটা বিলম্ব হয়।
অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিদের সুরতহাল ও ময়নাতদন্তে বিষাক্ত মদ্যপানের বিষটি প্রাথমিকভাবে স্পষ্ট হয়। অন্যরাও মদ্যপানে অসুস্থ হওয়ার বিষয়টি পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রীপুর থানায় অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে একটি মামলা করা হয়। পরে মামলাটি ডিবিতে স্থানান্তর হলে তদন্ত গতি পায়। গোপন সংবাদে ভিত্তিতে গাজীপুর জেলা পুলিশের ডিবির ওসি নিতাই চন্দ্র সরকারের নেতৃত্বে একটি দল অভিযান চালিয়ে ঢাকার নিকুঞ্জ এলাকা থেকে জাহিদ মৃধাকে গ্রেপ্তার করে।
ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার জহিরুল জানান, গ্রেপ্তার জাহিদ মৃধা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অ্যালকোহল সরবরাহের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
সারাহ রিসোর্টের ম্যানেজার রনি নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, জাহিদ মৃধা রিসোর্টের কেউ না। তার সঙ্গে সারাহ রিসোর্টের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি কীভাবে অ্যালকোহল সরবরাহ করেছিলেন তাও জানা নেই তাদের।
সারাহ রিসোর্টে যাওয়া ফোরথটপিআর একাধিক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার রাতে সেখানে বারবিকিউ পার্টি হয়। অনেকেই সেখানে মদ্যপান করেন। রাতের পার্টি ভালোভাবে শেষ হলেও শনিবার দুপুরে ঢাকায় ফেরার পর তিন জন বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারা হলেন শিহাব জহির, মীর কাউছার ও শরীফ জামান।
সারাহ রিসোর্টের খাবারে কোনো সমস্যা হয়নি বলে দাবি করেছে ওই প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন। গত ১ ফেব্রুয়ারি সোমবার তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুক্রবার রাতে আমাদের এখানে প্রায় দুইশ জন খাবার খেয়েছে। আমাদের রিসোর্টে আরও অনেকগুলো গ্রুপ ছিল। এশিয়াটিকের দুই প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন বাদে আর কেউ অসুস্থ হওয়ার খবর আমরা পাইনি। আমাদের খাবার খেয়ে অসুস্থ হলে একই খাবারে অন্যেরাও অসুস্থ হতেন।’
রিসোর্টে মদের লাইসেন্স নেই বলে জানিয়েছেন ইসমাইল হোসেন। এ কারণে তাদের রিসোর্ট ম্যানেজমেন্ট থেকে মদের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি বলে জানান তিনি।
এশিয়াটিকের অফিস ম্যানেজমেন্ট থেকে মদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলে ১ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছিলেন অবকাশ যাপনে যাওয়া কর্মীদের একজন। তবে এই মদ কোথা থেকে আনা হয়, তা জানাতে পারেননি তিনি।
ওই কর্মী জানান, যারা ওই রাতে মদ্যপান করেছিলেন, তাদের অধিকাংশই অসুস্থ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। কয়েকজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। দুজন আইসিইউতে ভর্তি আছেন।
অবকাশ যাপনে যাওয়া কর্মীদের ধারণা, মদের মধ্যে হয়ত ভেজাল ছিল। যে কারণে যারা মদ পান করেছে, তারা প্রায় সবাই অসুস্থ হয়েছেন।
গাজীপুরের সারাহ রিসোর্টে কী ঘটেছিল, এ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ খোলেননি এশিয়াটিক ও তার অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা।
প্রতিষ্ঠানটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইরেশ যাকেরের ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার কল ও মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান এর আগে নিউজবাংলাকে জানিয়েছিলেন, সারাহ রিসোর্টে বারের কোনো লাইসেন্স নেই। ফলে অতিথিদের মদ সরবরাহ করা হলে সেটা খতিয়ে দেখা হবে। আর যদি বাইরে কোনো বার থেকে মদ আনা হয়ে থাকে, তাহলে লাইসেন্সধারী ব্যক্তি ছাড়া কীভাবে তারা তা বিক্রি করেছে, সে ব্যাপারে তদন্ত হবে।
মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা গেলে মদের মধ্যে ভেজাল ছিল কিনা, অনুসন্ধানে তা বেরিয়ে আসবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘সবার আগে জানতে হবে এই মদ তারা কোথা থেকে নিয়েছে।’
দেশে অ্যালকোহলের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নেই বলে জানা গেছে।
রাজধানীর একাধিক বারগুলোর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, সম্প্রতি এই সংকট দেখা দিয়েছে। এর কারণ হিসেবে বিদেশি অ্যালকোহল আমদানিতে শুল্কের কড়াকড়িকে দায়ি করছেন তারা।
রাজধানীর গ্রিনরোডের ডিপিএল রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তত তিন সপ্তাহ ধরে তাদের পার্সেল সেবা বন্ধ রয়েছে। সরবরাহ সংকটের কারণে শুধু বারের ভিতরে অ্যালকোহল পরিবেশন করা হচ্ছে।