বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সুন্দরবনে বাড়ছে চোরা শিকার

  •    
  • ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০৯:৪৩

সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় হরিণের মাংসের ক্রেতার অভাব নেই। ক্ষেত্র বিশেষে হোম ডেলিভারিও দেয়া হয়। অনেক ধনী পরিবার ও রাজনৈতিক নেতার বাড়ির ফ্রিজে হরিণের মাংস পাওয়া যায়।

সুন্দরবনের সিন্দুরবাড়িয়া খাল থেকে গত ৮ জানুয়ারি একটি জেলে নৌকা ও হরিণ শিকারের ৪০০ ফুট ফাঁদ জব্দ করে বন বিভাগ। চার জেলেকে আসামি করে মামলা হয়েছে। তবে সবাই পলাতক।

এর ১০ দিন পর ১৯ জানুয়ারি বাঘের চামড়াসহ র‍্যাব ও বন বিভাগের যৌথ অভিযানে এক জেলেকে আটক করা হয়।

তিন দিনের মাথায় ২২ জানুয়ারি শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দাবাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ১৯টি হরিণের চামড়াসহ উপজেলার দুই বাসিন্দাকে আটক করে বাগেরহাট ডিবি পুলিশ।

২ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বগুড়া ব্রিজ এলাকার খালপাড় থেকে ৪২ কেজি হরিণের মাংসসহ দুজনকে আটক করে ডিবি পুলিশ।

গ্রেপ্তার-আটক-মামলা নিয়মিত চলছে। কিন্তু সুন্দরবনে অবৈধ শিকার বন্ধ হয় না। বরং উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে চোরা হরিণ শিকারিদের তৎপরতা।

বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী গত ছয় মাসে জব্দ করা হয়েছে ২৩৪ কেজি হরিণের মাংস।

পাচার ঠেকাতে শরণখোলা রেঞ্জে ২৩ জানুয়ারি থেকে জেলেদের বনে ঢুকে মাছ শিকারের ছাড়পত্র দেয়া বন্ধ রেখেছে বন বিভাগ।

২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করে র‍্যাব। এর পরে বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বন বিভাগ দাবি করে, সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণ শিকার কমে এসেছে।

তবে বন বিভাগের পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, গত ছয় মাসে (১ জুলাই ২০২০ থেকে ৩ ফ্রেব্রুয়ারি) সুন্দরবন থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে ২৫ চোরাশিকারি। তাদের কাছে পাওয়া গেছে একটি বাঘের চামড়া, ২৩৪ কেজি হরিণের মাংস ও ২৫শ ফুট হরিণ শিকারের ফাঁদ। জব্দ করা হয়েছে নয়টি নৌকা আর মামলা হয়েছে ১৮টি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শরণখোলা এলাকার একাধিক জেলে ও বাসিন্দা জানান, সুন্দরবনে হরিণ শিকার এখন নিয়মিত ব্যাপার। মাছ শিকারের ছাড়পত্র নিয়ে ঢোকা কিছু লোক সুন্দরবনের হরিণ ও বাঘ হত্যায় জড়িত।

তারা জানান, এদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জেলেরা জড়িত থাকে। ছদ্মবেশে চোরাশিকারীরা বনের সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে মাংস বিক্রি করে।

স্থানীয়দের মতে, বনরক্ষীরা যে পরিমাণ হরিণের মাংস উদ্ধার ও শিকারীদের আটক করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হরিণ মারা গেছে শিকারিদের হাতে। হরিণের মাংস চড়া দামে গোপনে বিক্রি হয়। এক কেজি মাংসের দাম ১ হাজার ৫শ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা।

স্থানীয় কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় হরিণের মাংসের ক্রেতার অভাব নেই। ক্ষেত্র বিশেষে হোম ডেলিভারিও দেয়া হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও খোদ প্রশাসনের লোকজনও এই মাংসের ক্রেতা। অনেক ধনী পরিবার ও রাজনৈতিক নেতার বাড়ির ফ্রিজে সব সময় হরিণের মাংস পাওয়া যায়।

বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সুন্দরবনে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকরাও গোপনে হরিণের মাংস কেনে। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় হরিণের মাংস।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বন বিভাগ থেকে পাস-পারমিট নিয়ে ছদ্মবেশে থাকা এক শ্রেণির জেলে ও সুন্দরবন এলাকার বাসিন্দারাই বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচারের সাথে জড়িত।’

তবে শরণখোলা উপজেলার জনপ্রতিধিসহ স্থানীয় জেলেদের অভিযোগ শুধু জেলে, বনজীবী ও স্থানীয় বাসিন্দারা নয়, বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচারে বন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীরাও জড়িত।

২০১৯ সালের ২২ মে সর্বশেষ বাঘ শুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনে বর্তমানে বাঘ রয়েছে মাত্র ১১৪টি। এর মধ্যে ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত বন বিভাগের হিসেবে ৫৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে চোরাশিকারিদের হাতে।

স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে মাত্র ১৫টি বাঘ। লোকালয়ে ঢুকে পড়া ১৪টি বাঘকে পিটিয়ে মেরেছে স্থানীয়রা। একটি মারা গেছে ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে। বাকি ২৭টি বাঘ বিভিন্ন সময় হত্যা করেছে চোরাশিকারীরা।

ডিএফও মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘জেলে পারমিট নিয়ে বনে ঢুকে হরিণ হত্যা ও পাচারের অপরাধে বিভিন্ন সময় জেলে ও বনজীবীদের আটক করা হয়েছে। এছাড়া পারমিট বাদেও সুন্দরবনে অবৈধভাবে ঢুকে হরিণ হত্যা ও পাচারের অপরাধেও আটক হয়েছে অনেকে।’

তিনি জানান, চোরা শিকার ঠেকাতে ২৩ জানুয়ারি থেকে শরণখোলা রেঞ্জে পারমিট বন্ধ রেখেছে বন বিভাগ।

শরণখোলা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, ‘কিছু অসাধু জেলে বনজীবীদের অপরাধের দায় সকলের উপর দেওয়া যাবে না। সুন্দরবন আমাদের মায়ের মতো। আমাদের রুজি-রুটি এ বন থেকেই আসে। সুতরাং সকলকে অপরাধী ভাবা যাবে না।’

শরণখোলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রায়হান উদ্দিন শান্ত বলেন, ‘সুন্দরবনের হরিণ শিকার ও পাচারের সাথে শুধু যে জেলে-বনজীবীরা জড়িত এমনটা নয়। অনেক সময় সহযোগী হিসেবে বন বিভাগের কর্মকর্তা ও বনরক্ষীরাও এ ধরনের অপকর্মে জড়িত থাকে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘বন বিভাগের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। মূলত জেলে-বনজীবী ও তাদের নেপথ্যে একটি বড় সিন্ডিকেট রয়েছে শরণখোলা রেঞ্জের উপকূলীয় এলাকায়। এরাই বনের হরিণ শিকার ও পাচারের সঙ্গে জড়িত।’

কিছুদিন আগে বাঘের চামড়াসহ আটক হয় গাউস ফকিরের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গাউস পারমিট নিয়ে জেলে হিসেবে দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে সুন্দরবনে মাছ ধরে আসছিলেন। তার মতো অনেক জেলে হরিণ শিকার ও পাচারের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া এদের পেছনে গডফাদার হিসেবে কিন্তু স্থানীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। হরিণের মাংসের একটা ভাগ কিন্তু এরাও পায়।’

বন বিভগ থেকে সংগ্রহ করা তালিকা। গত ছয় মাসের চিত্র। ছবি: নিউজবাংলা

ডিএফও মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, এই চোরাশিকারীরা অনেক শক্তিশালী। এদের বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। এদের ধরতে সুন্দরবন সংলগ্ন লোকজন খুব একটা সহযোগিতা করে না। এদের বিরুদ্ধে মানুষ সাক্ষ্য দিতেও ভয় পায়। তারা এই সুযোগ নিয়ে আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে।’

সুন্দরবন এলাকার সন্দেহভাজন শিকারিদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।’

বাগেরহাটের পুলিশ সুপার পংঙ্কজ চন্দ্র রায় বলেন, ‘শরণখোলা-কেন্দ্রিক একটি বণ্যপ্রাণী পাচার চক্র আছে। এরাই মূলত হরিণের মাংস, চামড়া ও বাঘের চামড়াসহ বন্যপ্রাণীর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারের সঙ্গে জড়িত। এদের গডফাদারসহ এসব চোরাশিকারীদের ধরতে বাগেরহাট জেলা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ তৎপর রয়েছে।’

এ বিভাগের আরো খবর