বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় করা প্রতিটি মামলা বিচারে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। কোনো কোনো মামলা চলছে তিন দশকের বেশি। একটি মামলায় সবচেয়ে কম সময়ে রায় পাওয়া গেছে ১৪ বছরে।
১৯৮১ সালে জাতির পিতার কন্যা দেশে ফেরার পর তাকে হত্যায় অন্তত ১৯ বার চেষ্টার তথ্য জানাচ্ছে তার দল। এসব ঘটনায় অন্তত ১৩টি মামলার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে কোনো কোনো ঘটনায় মামলাও করা যায়নি। উল্টো এমনও হয়েছে মামলা হয়েছে হামলার শিকার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই।
যে মামলাগুলোর তথ্য মিলেছে, তার মধ্যে বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরায় একটিসহ বিচারিক আদালতে রায় হয়েছে মোট ছয়টির।
এর একটিও অবশ্য চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। উচ্চ আদালতে মামলাগুলোর মীমাংসায় রাষ্ট্রপক্ষের কোনো তৎপরতাও নেই।
বিচারিক আদালতে এখনও ঝুলে আছে আটটি মামলা, যেগুলোর অনেকগুলো নিষ্পত্তি নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা। এর কোনো কোনোটির ব্যাপারে তথ্যই পাওয়া যায় না।
ঝুলে থাকা মামলাগুলোর মধ্যে ১৯৮৮ সালে প্রকাশ্য জনসভায় গুলি করে ২৪ জনকে হত্যার ঘটনাও রয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার রাতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান। এরপর ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে দেশে ফেরার পরেও তার জীবন কেড়ে নিতে নানা সময় একের পর এক হামলা হয়েছে।
এসব হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ৬০ জন দলীয় নেতাকর্মী নিহত হওয়ার হিসাব আছে। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। এসব ঘটনার বিচার না হওয়ায় যাদের প্রাণহানি ঘটেছে সেই পরিবারগুলো বিচার পায়নি এখনও।
রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এসব মামলার শুনানির জন্য অবশ্যই আমরা উদ্যোগ নেব। একটার পর একটা মামলা শেষ করব।’
তিনি বলেন, ‘সাতক্ষীরায় হত্যা চেষ্টার যে মামলাটি ছিল। তার রায় হয়েছে। রায়ের জন্য আমি নিজেও এখন সাতক্ষীরায় আছি।
‘এ মামলাটি হাইকোর্টে স্থগিত হয়েছিল। সেখানে শুনানি করে আপিল বিভাগ হয়ে মামলাটির ট্রায়াল পর্যন্ত আমি লেগেছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় আরও যেসব মামলা বিচারের অপেক্ষায় আছে সেগুলো শেষ করব।’
বিচারিক আদালতের সব রায় উচ্চ আদালতে
শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার ঘটনায় প্রথম রায় আসে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর।
২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি বোমা পুঁতে হত্যার চেষ্টা হয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে ফাঁস হয়ে যায় সে চেষ্টা। আর সে সময় করা দুটি মামলার রায় হয় ১৮ বছর পর।
এই মামলায় জঙ্গি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ১০ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হয়।
উচ্চ আদালতে এই মামলাটিই এগিয়ে সবচেয়ে বেশি। ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে হাইকোর্ট বেঞ্চ আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি রায়ের তারিখ দিয়েছে।
মুফতি হান্নান অন্য একটি মামলায় ফাঁসিতে ঝুলেছেন। ফলে সেদিন জানা যাবে বাকি ৯ আসামির সাজা কী হবে।
দেশজুড়ে তুমুল আলোচিত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলা মামলারও বিচারিক আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৪ বছরে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানসহ আরও ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে বিচারক আদালত।
সোয়া দুই বছরেও এই মামলাটির শুনানি হয়নি হাইকোর্টে।
গত বছরের ১৬ আগস্ট মামলাটির পেপারবুক তৈরি হয়েছে। এখন প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ গঠন করে দিলেই মামলার শুনানি হবে বলে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান।
পাবনায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ২৬ বছর পর ২০১৯ সালের ৩ জুলাই নয়জনকে মৃত্যুদণ্ড, ২৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ১৩ জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ট্রেনমার্চ করার সময় পাবনার ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রেনের বগি লক্ষ করে বেশ কিছু গুলি করা হয়।
এই ঘটনায় সে সময় ঈশ্বরদী থানায় মামলা হয়। এতে ১৩০ থেকে ১৩৫ জনকে আসামি করা হয়। পরে পুলিশ পৌর বিএনপির সভাপতি মোকলেছুর রহমান বাবলু, পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টু, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আজিজুর রহমান শাহীনসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় আদালতে।
এর পরের রায়টি আসে ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর। সেদিন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রাজনৈতিক দল ফ্রিডম পার্টির ১১ জনকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দেয় ঢাকার একটি আদালত।
ঘটনাটি ২৮ বছর আগের। ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলি ও গ্রেনেড ছোড়া হয়।
২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর এই মামলায় ফ্রিডম পার্টির ১১ জনকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দেয় ঢাকার একটি আদালত।
এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে জনসভাস্থলে যাওয়ার পথে শেখ হাসিনার ট্রাক মিছিলে সশস্ত্র হামলায় প্রাণ হারান ২৪ জন। তাদের মধ্যে ৯ জনের মতো নিহত হন শেখ হাসিনাকে মানববর্ম তৈরি করে রক্ষা করতে গিয়ে। এ ঘটনায় করা মামলায় এখনও বিচারিক আদালত থেকে রায়ে আসেনি।
চার বছর পর ১৯৯২ সালে আইনজীবী শহীদুল হুদা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদাসহ ৪৬ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
ঘটনার ২২ বছর পর ২০২০ সালের ২৫ জানুয়ারি এই মামলার রায় আসে বিচারিক আদালতে। পাঁচ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় চট্টগ্রামের একটি আদালত। তবে উচ্চ আদালতে এখনও এর শুনানি হয়নি।
আজ এল আরও একটি রায়। সাতক্ষীরার সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ৫০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছে জেলার একটি আদালত।
এই ঘটনাটিও ঘটে সাড়ে ১৮ বছর আগে।
ধর্ষণের শিকার এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে দেখতে ২০০২ সালের ৩০ আগস্ট সাতক্ষীরার কলারোয়ায় যান সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা।
সড়কযোগে ঢাকায় ফেরার পথে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলা বিএনপি অফিসের সামনে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে।
সাতক্ষীরায় শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা
এ সময় শেখ হাসিনাকে লক্ষ করে গুলি ছোড়া হয়। এমনকি বোমা বিস্ফোরণ ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে।
যেসব মামলার রায় এখনও আসেনি
১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চতুর্থ জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের সময় ধানমন্ডির গ্রিন রোডে ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। এই ঘটনায় করা মামলার মীমাংসা হয়নি গত ৩০ বছরেও।
১৯৯৫ সালের ৭ মার্চ শেখ রাসেল স্কয়ারে সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময় শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালানো হয়। সশস্ত্র ওই হামলা থেকে বাঁচাতে নেতাকর্মীরা তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। এ ঘটনায় করা মামলাটিরও কোনো রায় আসেনি।
১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্মরণে বক্তৃতা করছিলেন। এ সময় হঠাৎ করে একটি মাইক্রোবাস থেকে শেখ হাসিনাকে লক্ষ করে গুলি ও বোমা ছোড়া হয়। এতে কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়। এ মামলাটির কোনো অগ্রগতি নাই।
১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছেলেমেয়েসহ ৩১ জনকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে ই-মেইল চালাচালির খবর আসে। এতে জানানো হয়, ওই ই- মেইলটি পাঠিয়েছিলেন ইন্টার এশিয়া টিভির মালিক শোয়েব চৌধুরী। ওই ঘটনায় মামলার বিচার কত দূর, তার কোনো তথ্যই পাওয়া যায়নি।
২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতুর কাজ উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ঘাতক চক্র সেখানে শক্তিশালী বোমা পুঁতে রাখে। বিস্ফোরণের আগেই বোমাটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয় গোয়েন্দা পুলিশ।
কোটালীপাড়ায় হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পর রূপসা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হরকাতুল জেহাদ।
কিন্তু তিন দিন আগে ২৭ মে সেতুর কাছাকাছি রূপসা নদী থেকে দুটি ইঞ্জিন নৌকা থেকে হুজি-বির ১৫ জঙ্গি ধরা পড়েন।
ওই ১৫ জনের একজন মাসুম বিল্লাহ ওরফে মুফতি মইন ঢাকায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অংশ নেন বলে তদন্তে বের হয়ে এসেছে।
২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এর তদন্ত আর আগায়নি।
২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়িবহরে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডে ওই হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, লুটতরাজের ঘটনায় প্রকৃত হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা না করে উল্টো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। পরে ওই মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়।