বিরোধী দলে থাকাকালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার আরও এক মামলায় রায় হয়েছে। দীর্ঘ ১৯ বছর পর সাতক্ষীরার কলারোয়ায় তার গাড়িবহরে হামলা মামলায় ৫০ জনকে নানা মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
সাতক্ষীরা-১ আসনের সাবেক সাংসদ হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ তিনজনকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক।
১০ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া বাকি দুজন হলেন মো. আরিফুর রহমান ওরফে রঞ্জু ও রিপন। এরা দুই জনই পলাতক।
পলাতক আসামি যুবদল নেতা আব্দুল কাদের বাচ্চুকে দেয়া হয়েছে নয় বছরের কারাদণ্ড। বাকি ৪৬ জন আসামিকে চার বছরের কারাদণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।
এ নিয়ে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টায় অন্তত পাঁচটি মামলার রায় ঘোষণার তথ্য পাওয়া গেল।
বৃহস্পতিবার আলোচিত এ মামলায় জেল হাজতে থাকা ৩৪ জন আসামির উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করেন সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম হুমায়ুন কবীর।
রায় ঘোষণা উপলক্ষ্যে সকালে আদালত চত্বরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বিপুল সংখ্যক পুলিশ অবস্থান নেয় সেখানে। গণমাধ্যমকর্মী ও বিচারপ্রার্থী ছাড়া বাকিদের ঢুকতে দেয়া হয়নি।
এই রায় নিয়ে রাষ্ট্র ও আসামি- দুই পক্ষ থেকেই অসন্তোষ জানানো হয়েছে। দুই পক্ষই বলছে, তারা ন্যায়বিচার পায়নি।
মামলাটি পরিচালনা করতে ঢাকা থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে প্রতিনিধি পাঠানো হয়। রায় ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এসএম মুনীর। তিনি বলেন, ‘আমরা সন্তুষ্টও না, অসন্তুষ্টও না। রায় পর্যবেক্ষণ করে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা মামলায় সাবেক সাংসদ হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। ছবি: ফোকাস বাংলা
আসামির আইনজীবী ও দণ্ডিত হাবিবুল ইসলাম হাবিবের স্ত্রী শাহনাজ পারভিন বকুলও বলেছেন তারা সন্তুষ্ট নন। বলেছেন, আপিল করবেন। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এটা সাজানো। আমরা হাইকোর্টে যাব। আমরা সেখানে নিশ্চয় ন্যায্য বিচার পাব।’
সাতক্ষীরায় আনন্দ মিছিল
শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা মামলার রায়ের পর শহরে আনন্দ মিছিল করে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা। ছবি: নিউজবাংলা
রায়ের পর সন্তোষ প্রকাশ করে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে শহরে মিছিল করেছেন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা।
আর যে ৪৬ জনের সাজা
সাজা পাওয়া ৫০ জনের মধ্যে চার জনের নাম উপরে আছে।
অপর আসামিরা হলেন, আশরাফ হোসেন, নজরুল ইসলাম, মো. আব্দুর রাজ্জাক, শেখ তামিম আজাদ মেরিন, মো. আব্দুর রকিব মোল্যা, মো. আক্তারুল ইসলাম, আব্দুল মজিদ, হাসান আলী, ময়না, আব্দুস সাত্তার, তোফাজ্জেল হোসেন সেন্টু, জহুরুল ইসলাম।
আরও আছেন গোলাম রসুল, আব্দুস সাত্তার, আব্দুস সামাদ, আলতাফ হোসেন, শাহাবুদ্দিন, সাহেব আলী, সিরাজুল ইসলাম, রকিব, ট্রলি শহীদুল, মনিরুল ইসলাম, শেখ কামরুল ইসলাম, ইয়াছিন আলী, শেলী, শাহিনুর রহমান, দিদার মোড়ল।
বাকিরা হলেন সোহাগ হোসেন, মাহাফুজুর মোল্লা, আব্দুল গফফার গাজী, রিঙ্কু, আব্দুস সামাদ, টাইগার খোকন ওরফে বেড়ে খোকন।
যারা পলাতক
সাজাপ্রাপ্ত পলাতক অপর আসামিরা হলেন আব্দুল কাদের বাচ্চু, মফিজুল ইসলাম, মো. আলাউদ্দিন, খালেদ মঞ্জুর রোমেল, ইয়াছিন আলী, রবিউল ইসলাম, মাজাহারুল ইসলাম, আব্দুল খালেক, আব্দুর রব, সঞ্জু, নাজমুল হোসেন, জাবিদ রায়হান লাকী, কনক, মাহাফুজুর রহমান।
যা ঘটেছিল
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০২ সালের ৩০ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার চন্দনপুর ইউনিয়নের হিজলদি গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার ধর্ষিতা স্ত্রীকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে দেখতে যান।
সড়কপথে যশোরে ফেরার পথে কলারোয়া উপজেলা বিএনপি অফিসের সামনে তার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটে। শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। বোমা বিস্ফোরণ ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে।
সে সময় হত্যাচেষ্টা, বিস্ফোরক দ্রব্য ও অস্ত্র আইনে তিনটি মামলা করা হয়।
হামলার পর এ ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোসলেম উদ্দীন বাদী হয়ে উপজেলা যুবদলের সভাপতি আশরাফ হোসেনসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ৭০ থেকে ৭৫ জনকে আসামি করে থানায় মামলা করতে যান। তবে তাতে ব্যর্থ হওয়ায় আদালতে মামলা করেন তিনি।
১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর তাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা করা হয় বলে আওয়ামী লীগ জানিয়েছে
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মামলাটি আটকে থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর কলারোয়া থানায় মামলাটি রেকর্ড করা হয়।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৫ সালে বিএনপির তৎকালীন সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা, বিস্ফোরক দ্রব্য ও অস্ত্র আইনে তিনটি মামলা হয়। ওই মামলায় তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন হয়।
২০১৫ সালের ১৭ মে হাবিবসহ ৫০ জনের নাম উল্লেখ করে ৩০ জনকে সাক্ষী করে সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেখ সফিকুর ইসলাম।
এই মামলাটির শুনানি থামাতে হাইকোর্টে একের পর এক আবেদন করেছেন আসামিরা।
একটি আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়ে রুল জারি করে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর সেই রুলের ওপর শুনানি শুরু হয়। এরপর গত ৬ অক্টোবর সে রুলের শুনানি শেষে রুলটি খারিজ করে হাইকোর্ট।
গত ৮ অক্টোবর মামলাটি তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
সবশেষ আবেদন হয় আসামি রাকিবুর রহমানের পক্ষ থেকে। ঘটনার সময় তিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন দাবি করে এই মামলায় বিচার ঠেকানোর চেষ্টা করেন তিনি। তবে গত ২৪ নভেম্বর তার আবেদন খারিজ হলে এই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করতে আর কোনো আইনি বাধা থাকেনি।
গত ২৭ জানুয়ারি যুক্তিতর্ক শেষে কাঠগড়ায় থাকা ৩৪ জনকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. হুমায়ুন কবীর। মামলার ১৬ জন আসামি পলাতক রয়েছেন।