বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরসূচি চূড়ান্ত হয়েছে। তবে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কবে আসছেন, সেটি এখনও নিশ্চিত নয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে নিউজবাংলাকে বলেন, এরদোয়ান মার্চে আসার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তবে তার সূচি চূড়ান্ত হতে পারে ৭ ফেব্রুয়ারি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব ইউরোপ ও সিআইসি বিভাগের মহাপরিচালক শিকদার বদিরুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে হওয়া বৈঠকে এরদোয়ান মার্চ মাসেই বাংলাদেশ ভ্রমণের কথা বলছিলেন। এ নিয়ে দুই দেশ কাজ করছে। তবে সফর চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে ৭ ফেব্রুয়ারি।’
বাংলাদেশ এরদোয়ানকে আমন্ত্রণ জানানোর পর তুরস্কের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি হলে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান ঢাকায় আসবেন।
বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। বুধবার পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার কমে ২.৯১ শতাংশ হয়েছে।
এ দিন মিলে টানা ১৬ দিন সংক্রমণের হার পরীক্ষার বিবেচনায় পাঁচ শতাংশের নিচে নেমেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা বলছে, পরীক্ষার বিবেচনায় সংক্রমণ হার টানা দুই সপ্তাহ পাঁচ শতাংশের নিচে থাকলে করোনা নিয়ন্ত্রণে ধরা যাবে।
আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ঘটা করে উদযাপন করতে চায় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আয়োজনে।
এই বছরটি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি কারণে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হবে আগামী ১৭ মার্চ। গত ১৭ মার্চ থেকে এই উপলক্ষ্যে শুরু হয়েছে মুজিববর্ষ, যেটির মেয়াদ আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পাশাপাশি মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ যাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের মধ্যে আছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর শুরু হওয়া যুদ্ধে যোদ্ধাদের পাশাপাশি ভারত আশ্রয় দিয়েছে এক কোটি শরণার্থীকে।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার কাজ করেছে কলকাতা থেকে। ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র দিয়েছে, বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করেছে। পাশাপাশি ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সেদিনই ভারত নিজে যোগ দেয় যুদ্ধে।
১০ দিনের মাথায় ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর কাছে।
আগামী ২৬ মার্চ মোদি আসছেন, এটি চূড়ান্ত হয়ে গেছে। দেশে এসে প্রথম ভারতীয় সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য যেতে চান। মোদি নিজেই এই প্রস্তাব দিয়েছেন। যদিও বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সূচি চূড়ান্ত হয়েছে
১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও তুরস্ক অবস্থান নেয় পাকিস্তানের পক্ষে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে কূটনৈতিক অঙ্গনে কাজ করার পাশাপাশি পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তাও দেয় দেশটি।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান মানবতাবিরোধী অপরাধী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।
সে সময় সম্পর্কের তলানিতে থাকলেও সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হন এরদোয়ান। করোনা পরিস্থিতিতে একাধিক বার বাংলাদেশকে চিকিৎসা সহায়তা দেয় দেশটি।
ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন ইস্যুতে ধর্মভিত্তিক দলগুলো যখন গোলযোগের চেষ্টা করছিল, তখন তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের ঘোষণাটি চমক তৈরি করে। তিনি জানান, এরদোয়ান সরকার তার টাকায় দেশটির রাজধানী আঙ্কারায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানাবে। পাশাপাশি ঢাকায় বসানো হবে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতাতুর্কের ভাস্কর্য।
বাংলাদেশে গৃহহীনদের জন্য ঘর করে দিতে চাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছে তুরস্ক। বিষয়টি এখন চূড়ান্ত না হলেও সরকার যে ঘর করে দিচ্ছে, একই রকমের ঘর করতে কী পরিমাণ খরচ হয় তার হিসাব নিয়ে গেছেন ঢাকায় তুরস্কের রাষ্ট্রদূত।
এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী মার্চে এরদোয়ানকে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তুরস্কের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, এরদোয়ান আসবেন।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মোস্তফা ওসমান তুরানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর এই বিষয়টি নিশ্চিত করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।
ওই দিন তিনি বলেছিলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে তিনি বাংলাদেশ সফরে আসবেন। এটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। আগামী বছর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন এরদোয়ান।’
গত ২২ ডিসেম্বর দুই দিনের সফরে ঢাকা আসেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেবলুত সাবুসোলু। তখনও এরদোয়ানের ঢাকা সফরের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেবলুত সাবুসোলু
তুরস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বরফ গলা শুরু অবশ্য ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকে। এই সংকটে বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দেয় তুরস্ক।
রোহিঙ্গাদের দেখতে কক্সবাজারে ছুটে আসেন তুরস্কের একাধিক প্রতিনিধি। আসে ত্রাণ ও চিকিৎসাসামগ্রী। উখিয়ায় তৈরি হয় রোহিঙ্গাদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল।
দুই দেশের সম্পর্কের সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। সে দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। সেই সফরে তিনি বৈঠক করেন এরদোয়ানের সঙ্গে।
বৈঠকে বাংলাদেশ সফরের আগ্রহের কথা জানান এরদোয়ান। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য এক বিলিয়ন ডলার থেকে তিন বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে অংশগ্রহণে আগ্রহ দেখান তিনি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সামরিক ও বাণিজ্যিক বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়েই নতুন সম্পর্কের দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ ও তুরস্ক।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসে অস্ত্র বিক্রিতে আগ্রহের কথা বলেছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে অস্ত্র উৎপাদনের প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি। যদিও এ বিষয়ে সবশেষ অগ্রগতির খবর দেয়নি কোনো পক্ষ।