বগুড়ায় ‘বিষাক্ত মদ্যপানে’ তিন দিনে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ১৬ জনে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে মঙ্গলবার ভোর থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যে মারা গেছেন ছয়জন।
এর আগে রোববার থেকে সোমবার রাত পৌনে নয়টার মধ্যে মৃত্যু হয় দশ জনের।
সর্বশেষ মৃত ছয়জন হলেন-বগুড়া শহরের আলমগীর হোসেন ও রামনাথ, শাজাহানপুর উপজেলার মেহেদি হাসান, আব্দুর রাজ্জাক ও আব্দুল আহাদ এবং সারিয়াকান্দির লাজু মিয়া।
এর আগে মারা যান বগুড়া শহরের তিনমাথা এলাকার রমজান আলী, সুমন রবিদাস ও প্রেমনাথ, ফুলবাড়ী এলাকার আবদুল জলিল, পলাশ মিয়া ও আব্দুর রহিম, কাটনারপাড়া এলাকার সাজু ও মোজাহার আলী, সদরের ফাঁপোর এলাকার জুলফিকার রহমান ও কাহালু উপজেলার উলট্ট মহল্লার আবু কালাম।
এ ঘটনায় সোমবার করা মামলায় মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১১টার মধ্যে চার জনকে আটক করা হয়।
বগুড়ার সদর সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ বলেন, ‘মুন হোমিও, পারুল হোমিও, করতোয়া হোমিও, করমোটেরি হাসান হোমিও হল থেকে তাদের আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের আটক করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম আপাতত প্রকাশ করা হচ্ছে না।‘
পুলিশ জানিয়েছ, মৃতদের মধ্যে আটজনকে পরিবারের সদস্যরা দাফন করেছেন। বাকিদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্যে মর্গে রয়েছে।
সোমবার প্রথমে যে ছয়জন মারা যান তাদের সম্পর্কে পুলিশ কর্মকর্তারা দাবি করেছিলেন, তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বিষাক্ত মদ্যপানে, বাকিদের স্ট্রোকে। তবে একদিন পরই এই অবস্থান থেকে সরে এসেছে পুলিশ। এখন তারা বলছে, ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
শাজাহনপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল্লাহ আল মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে মরদেহগুলো ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে ছয়জন মঙ্গলবার মারা গেছেন তাদের মধ্যে সারিয়াকান্দির লাজু পেশায় রিকশাচালক। পাশাপাশি অ্যালকোহল বিক্রি করতেন তিনি। তার ভাই শফিকুলও মদ্যপান করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই লাজু ও শফিকুলের বুক জ্বলা-পোড়া করছিল বলে তারা চিৎকার করছিলেন। হাসপাতাল নেয়ার পথে লাজুর মৃত্যু হয়। এর পর আত্মগোপন করেছেন তার ভাই শফিকুল। লাজুর বিরুদ্ধে একাধিক মাদক মামলা রয়েছে।
বগুড়ার শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, বগুড়ার ফুলবাড়ী এলাকার পলাশ মিয়াকে সোমবার রাত ১১টার দিকে মেডিক্যালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান।
পলাশের ভাই পায়েল জিয়াউর রহমান মেডিক্যালে ভর্তি। তারা পারুল ল্যাব নামক একটি দোকান থেকে ‘রেকটিফাইড অ্যালকোহল’ কেনেন একজনের কাছ থেকে। গত শনিবার সন্ধ্যায় খাওয়ার পর তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন।
পায়েলের স্ত্রী জানান, শনিবার তাদের পরিবারের একজনের জন্মদিন ছিল। এ কারণে তার স্বামী, দেবর ও দেবরের বন্ধু শখ করে মদ খান। সোমবার হাসপাতালে নেওয়ার পর পলাশ মারা যান।
হাসপাতালেই পলাশের ভাগনে বাঁধন জানান, জন্মদিনের অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে শনিবার সন্ধ্যায় তার মামার সঙ্গে আব্দুর রহিম নামের আরেকজনও মদ্যপান করেন। পরে তিনি তার বাড়ি ফুলবাড়ী দক্ষিণ পাড়ায় যান। সেখানে রোববার মারা যান রহিম।
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আইয়ুব জানান, শহরের মধ্যে পারুল ল্যাব নামক একটি দোকানের কর্মচারী রুস্তমের কাছ থেকে শনিবার তিনি ‘রেকটিফাইড অ্যালকোহল’ কেনেন।
তিনি বলেন, ‘এটা ভালো মাল (মদ), খুব নেশা হবে। খাওয়ার পর বুঝতে পারছি, এটা ভয়ংকর। তবে অন্য দিন একই দোকান থেকে মাল কিনে খেয়েছি, কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। শনিবার খেয়েই সমস্যা হলো।’
হাসপাতালে ভর্তি শিববাটি এলাকার হোটেলশ্রমিক রঞ্জু। তিনি বলেন, ‘পারুল ল্যাব থেকে প্রতিদিন কিনে খাই। অন্য দিন কোনো সমস্যায় পড়িনি। শনিবার কিনে খাওয়ার পরেও কোনো সমস্যা হয়নি। রোববার সকালে সমস্যা শুরু হয়। এরপর সোমবার সাজুর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর আমি নিজে এসে হাসপাতালে ভর্তি হই।’
মৃত সুমন রবিদাসের ভাই সুজন রবিদাস বলেন, ‘রমজান তাদের এলাকার বাসিন্দা। তারা শহরের তিনমাথা রেলগেট এলাকায় শাহীন হোমিও নামের একটি দোকান থেকে স্পিরিট কিনে খান। এটা খেয়েই রমজান অসুস্থ হয়ে তার নিজ বাড়িতে মারা যান।’
বিষাক্ত মদ খেয়ে শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন পলাশের ভাই আতিকুর রহমান পায়েল, পায়েলের বন্ধু আইয়ুব ও শিববাটি এলাকার হোটেল শ্রমিক রঞ্জু। এছাড়া শাজাহানপুর উপজেলার পাঁচজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বগুড়া সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ মঙ্গলবার রাতে মোবাইল ফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আটজনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ফল আসলে বিস্তারিত বলা যাবে। অভিযান চালিয়ে সন্ধ্যা থেকে চার জনকে আটক করা হয়েছে।‘
বিষাক্ত মদ বিক্রির বিষয়ে বগুড়া সদর থানায় সোমবার রাতে তিনজনের নামে মামলা হয়। মৃত রঞ্জুর বড় ভাই মনোয়ার বাদী হয়ে মামলা করেন। আসামিরা হলেন খান হোমিও হলের শাহিনুর রহমান শাহীন, পারুল ও পুনম হোমিও হলের নুর আলম ও নুর নবী।