মানব ও অর্থ পাচারের দায়ে কুয়েতে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের কারাদণ্ড হওয়ায় তিনি আর সংসদ সদস্য থাকতে পারবেন না- এ বিষয়ে আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত।
তবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর, যিনি বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক তথ্যের অপেক্ষায়।
গত বছরের জুনে পাপুল কুয়েতে বন্দি হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার খবর প্রকাশ হলেও স্পিকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য দেয়া হয়নি।
বৃহস্পতিবার তাকে কুয়েতের একটি আদালত চার বছরের কারাদণ্ড দেয়ার বিষয়টিও শিরীন শারমিন জেনেছেন গণমাধ্যম থেকে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা এখনো পেপার পত্রিকাতেই দেখেছি। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানার চেষ্টা করছি। এরপর আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি আর সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হন না।
সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে বলা আছে, সংসদ সদস্য কোনো ফৌজদারি অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে বা আদালতে দণ্ডিত হলে বা কোনো নির্বাহী আদেশ আটক হলে, গ্রেপ্তারকারী বা দণ্ডদানকারী বা আটককারী কর্তৃপক্ষ বা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী কর্তৃপক্ষ যথাযথ ফরমে গ্রেপ্তার, দণ্ডাদেশ বা আটকের কারণসহ পুরো বিষয় স্পিকারকে জানাবে।
একইভাবে গ্রেপ্তার হয়ে দণ্ডপ্রাপ্তির পর আপিলের বিবেচনা সাপেক্ষে জামিনে মুক্ত হলে বা অন্যভাবে মুক্ত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একইভাবে স্পিকারকে অবহিত করবে।
তবে পাপুলকে বাংলাদেশের কোনো কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার করেনি, ফলে এই প্রক্রিয়ায় স্পিকারের তথ্য জানার সুযোগ ছিল না।
পাপুল গ্রেপ্তারের পর সে সময় সরকার তার বিষয়ে তথ্য চেয়ে কুয়েত সরকার এবং ঢাকায় কুয়েত দূতাবাসে যোগাযোগ করেছিল বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। তবে কোনো তথ্য দেয়া হয়েছিল কি না, এ বিষয়ে পরে মন্ত্রী কিছু জানাননি গণমাধ্যমকে।
অবশ্য গত অক্টোবরে কুয়েত সফরে গিয়ে এই বিষয়ে সে দেশের সরকারের সঙ্গে পাপুলের বিষয়ে কোনো আলোচনা করেননি বলেও জানান মন্ত্রী।
সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, যেহেতু দেশের বাইরে পাপুলের কারাদণ্ড হয়েছে, সেহেতু বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংসদকে জানাতে হবে। এর আগে স্পিকারের পক্ষ থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু করার সুযোগ নেই।
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে দেশে সাজা হয়েছে, সে দেশে আমাদের যে রাষ্ট্রদূত রয়েছেন, তিনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানাবেন। মন্ত্রী আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে জানাবেন। পরে সংসদীয় কার্যালয়ের সচিব স্পিকারকে বিষয়টি জানাবেন।’
জাতীয় সংসদের হুইপ নূর ই আলম চৌধুরী লিটন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা আনুষ্ঠানিকভাবেই নিয়ম অনুযায়ী কাগজপত্র পাব, সেটা কুয়েত দূতাবাসের মাধ্যমেই পাব। কাগজ আসলে আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
সংসদ সদস্য থাকার আর যোগ্যতা নেই
সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ মনে করেন, সংবিধানের যে বিধান, তাতে পাপুলের বাংলাদেশে শাস্তি হতে হবে, এটা জরুরি নয়।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যেখানে দুই বছর হলেই সংসদ সদস্য পদ থাকে না, সেখানে বেশি হলে তো কথাই নেই। নিয়ম অনুযায়ী পাপুলের সংসদ সদস্য পদ থাকে না।’
আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘সেখানে যে কোনো ফৌজদারি অপরাধে নৈতিক স্খলনের দায়ে সাজা হলে তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। এটি আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট করে বলে দেয়া আছে।’
বিদেশে সাজা হলে সেটি এদেশে কার্যকর হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাজা যে কোনো দেশেই হোক। তার সংসদ সদস্য পদ থাকে না। কেন না সংবিধানে তো বলে দেয়া নাই যে দেশের মধ্যে অপরাধ হলেই কেবল তার জন্য এই সাজা।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধানের স্পিরিটটা বুঝতে হবে। এক জন সংসদ সদস্য যিনি কোন নৈতিক স্খলনে দোষী সাব্যস্ত হবেন না। হলে তার পদ থাকবে না কিংবা তিনি প্রার্থীও হতে পারবেন না।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী তিনি (পাপুল) আর সংসদ সদস্য নন। নৈতিকভাবেও তিনি সংসদ সদস্য থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনারের বিষয় নয়। আইন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছে স্পিকারকে। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন।’
পাপুল যেভাবে সংসদ সদস্য
সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েতে যাওয়ার কয়েক দশকের মধ্যে ধনকুবের হয়ে যাওয়া পাপুল একাদশ সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য হন।
সে সময় তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয় বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল।
তবে ভোটের আগে আগে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ নোমান সরে দাঁড়ান। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পাপুলের পক্ষে কাজ করেন।
পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলামও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সংসদের আসন বণ্টনের হিসাবে নারী আসনের একটি পেয়েছিলেন এবং তারা সেলিনাকে মনোনয়ন দেন।
পাপুলের স্ত্রীও আসামি
পাপুলের পাশাপাশি তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম মেয়ে ওয়াফা ইসলাম ও শ্যালিকা জেসমিন প্রধানও অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচার মামলার আসামি।
দুর্নীতি দমন কমিশন গত ১১ নভেম্বর মামলাটি করে। এই মামলায় সেলিনা এবং ওয়াফা গত ২৭ ডিসেম্বর জামিন পান।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, জেসমিন প্রধান দুই কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৮ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
‘কাগুজে প্রতিষ্ঠান’ করে তিনি ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৪৮ কোটি টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করেছেন বলেও বলা হয় মামলায়।
বলা হয়, এসব কাজে পাপুল, তার স্ত্রী ও মেয়ে সহযোগিতা করেছেন।
পাপুল কুয়েতে গ্রেপ্তারের পর গত বছরের ২২ জুলাই সেলিনা ইসলাম ও জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।
সেলিনা ইসলাম এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলাম ও শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের আট ব্যাংকের ৬১৩টি হিসাব জব্দও করেছে দুদক।
তাদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা ৩০ দশমিক ২৭ একর জমি ও গুলশানের ফ্ল্যাট বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্তও নিয়েছে দুদক। এজন্য সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়েও চিঠি দিয়েছে কমিশন।
পাপুলকে গত ৬ জুন রাতে কুয়েতের মুশরিফ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। মারাফি কুয়েতিয়া কোম্পানির অন্যতম মালিক পাপুলের সেখানে বসবাসের অনুমতি রয়েছে।
পাচারের শিকার পাঁচ বাংলাদেশির অভিযোগের ভিত্তিতে পাপুলের বিরুদ্ধে মানবপাচার, অর্থপাচার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগ মামলা করা হয়।