গৃহহীনদের জন্য নির্মিত সরকারি ঘরের চাবি নিলেও তাতে উঠতে চাইছেন না ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের সাবেক সংসদ সদস্য এনামুল হক জজ মিয়া।
ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানালেও বিষয়টি নিয়ে প্রচার হওয়ায় তিনি এখন লজ্জা পাচ্ছেন। বলেছেন, ওই পরিবেশে থাকা তার জন্য অস্বস্তিকর।
আর স্থানীয় প্রশাসনও বিষয়টি আমলে নিয়েছে। সাবেক এমপির জন্য আরও মানসম্মত ও আলাদা একটি আবাসনের চিন্তা করা হচ্ছে।
জজ মিয়ার জন্য গফরগাঁও সদর উপজেলায় সরকারি কোনো খাস জমি খুঁজছে উপজেলা প্রশাসন। পেলে সেখানে আলাদা একটি বাড়ি তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হবে।
জজ মিয়া জানিয়েছেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে সরকারি সুযোগ সুবিধা নেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে আট বছরের সন্তানের কথা ভেবে এখন সনদ ও সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
আট বছরের সন্তানের সঙ্গে সাবেক সাংসদ জজ মিয়া
গত ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬৬ হাজারেরও বেশি মানুষের হাতে নতুন ঘরের চাবি তুলে দেন। এই মানুষগুলো নিতান্তই নিম্ন আয়ের। তাদের নিজের কোনো ঘর ছিল না কখনও। মানুষের ঘরে, রাস্তার পাশে ছাপড়া তুলে, রাস্তার ধারে, দোকানের বারান্দায় শুয়ে রাত কাটত তাদের।
এত মানুষের ভিড়েও গফরগাঁওয়ের জজ মিয়ার ঘর প্রাপ্তি বড় খবর হয়ে আসে গণমাধ্যমে।
সেদিন তিনি হাসিমুখে স্থানীয় সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের হাত থেকে চাবি নিলেও চার দিনেও ঘরে উঠেননি।
কারণ জানতে চাইলে জজ মিয়া বলেন, ‘আমার দুরাবস্থা দেখে সরকার আমাকে একটি স্থায়ী ঘরের ব্যবস্থা করেছে আমি এতে খুশি। কিন্তু সরকার আমার ঘরটা যদি আলাদা কোনো স্থানে দিত তাহলে আমার জন্যে ভালো হতো।’
তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে পরিচিতরা অনেকে অনেক কথা বলছে, নিজের কাছে বিষয়টা লজ্জা লাগছে।’
এমন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে কখনও ভাবেনি তিনি। জানান, জীবনে শত শত মানুষকে চাকরি দিয়েছেন, শত শত মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। কখনও কারও কাছ থেকে বিনিময়ে কিছু নেননি।
এক সময় গফরগাঁও পৌর শহর ও ঢাকায় বহুতল বাড়ি ছিল জজ মিয়ার।
জজ মিয়ার জন্ম গফরগাঁওয়ের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে । তার দাদা মৌলভী হালিম উদ্দিন ভারতের হুগলী মহসীন মাদ্রাসা থেকে ১৮৮৪ সালে ফাজেল পাস করেন। তিনি ১৮৯২ সালে সালটিয়া হাটের পাশে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই গফরগাঁওয়ের প্রথম মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
জজ মিয়ার বাবা আব্দুছ ছালাম ১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম পাস করেন। তিনি ২২ বছর ইসলামিয়া সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি গফরগাঁও সরকারি কলেজেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
তিনি চরআলগী ইউনিয়ন পরিষদের ২২ বৎসর প্রেসিডেন্ট ও পাঁচ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন।
জজ মিয়া ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে ময়মনসিংহ-১০ গফরগাঁও আসন থেকে জাতীয় পার্টির হয়ে দুই বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি বিয়ে করেছেন মোট তিনটি। তার প্রথম স্ত্রী তাদের মেয়েকে নিয়ে আমেরিকায় থাকেন।
দ্বিতীয় স্ত্রীকে ঢাকার পুরানা পল্টন ও মিরপুর কাজীপাড়ায় দুটি বাড়ি লিখে দিয়েছেন জজ মিয়া।
তৃতীয় স্ত্রী ও আট বছরের সন্তান এলাহীকে নিয়ে গফরগাঁও উপজেলার একটা ছোট্ট ভাড়া বাসায় জীবন কাটাচ্ছেন এরশাদ শাসনামলের এই এমপি।
জজ মিয়া নিঃস্ব হয়েছেন তার উদার মনের কারণে। গফরগাঁও পৌর শহরে শেষ সম্বল ১২ শতাংশ জমি মসজিদের নামে লিখে দিয়েছেন। এরপর থেকে এক রুমের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে মেঝেতে থাকছেন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আট বছরের ছেলের ভবিষ্যতের চিন্তা করে এক সময় হেলায় না নেয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদও নিতে চাইছেন জজ মিয়া।
তিনি বলেন, ‘ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কয়েকবার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সনদটা আমি পাইনি। অনেকের কাছে ধর্ণা দিলেও মেলেনি সেই সনদ। যদি সনদটি পেতাম তাহলে আমার সন্তানটাকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করতে পারতাম।’
ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উপজেলায় গৃহহীনদের তালিকায় নাম আসায় সাবেক দুই বারের সাংসদকে ঘর দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে তাকে অন্যান্য সুযোগের আওতায় আনা হবে।’
স্থানীয় সংসদ সদস্য ফাহমী গোলন্দাজ বাবেলের হাত থেকে চাবি নিলেও এখনও সেই ঘরে ওঠেননি সাবেক সাংসদ জজ মিয়া
গফরগাঁও পৌর মেয়র ইকবাল হোসেন সুমন বলেন, ‘আমরা তার এমন দুরাবস্থার কথা জানতে পেরে কিছুদিন আগে তাকে ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা করেছি। আমরা তার খোঁজ খরব রাখছি। আগামীতেও আমরা তাকে সহযোগিতা করব।’
গফরগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ‘ভূমিহীন ও গৃহহীন তালিকায় তাকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করা হয়। আমরা তাকে ঘরের পাশাপাশি অন্যান্য গৃহ সামগ্রী দেয়ার ব্যবস্থা করব। আর তার ইচ্ছে পূরণে পৌর এলাকায় আলাদাভাবে একটি ঘর দেয়ার চেষ্টা করব।’