বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গৃহকর্মী নিয়োগ: প্রশ্ন দুই পক্ষের নিরাপত্তা নিয়েই

  •    
  • ২৭ জানুয়ারি, ২০২১ ০৯:৩৩

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে স্থানীয় থানায় ভাড়াটেদের তথ্য দিতে যে ফরম ছাড়া হয়েছে, নানা ঘটনার পর সেখানে গৃহকর্মীর তথ্যও দেয়ারও নিয়ম করা হয়। তবে এই তথ্য দেয়ার প্রবণতা একেবারেই কম।

রাজধানীর মালিবাগে বাসা ফাঁকা পেয়ে এক বৃদ্ধাকে গৃহকর্মীর নির্মম পিটুনির ভিডিও প্রকাশের পর নিন্দার পাশাপাশি ঝুঁকি নিয়েও আলোচনা কম নয়।

এর আগে নানা সময় ফাঁকা বাসায় শিশু গৃহকর্মীদের নির্যাতনের ভিডিও এসেছে সামনে। গৃহকর্মীকে নির্মমভাবে পিটুনি এমনকি হত্যার ঘটনা ঘটেছে নানা সময়। এ জন্য গৃহকর্ত্রী বা গৃহকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছেন, সাজাও হয়েছে।

অর্থাৎ নিরাপত্তাহীনতা দুই পক্ষ থেকেই হতে পারে। তবে সবার বাসায় সিসিটিভি ক্যামেরা থাকে না বলে পুরো চিত্র পাওয়া কঠিন।

তবে ঝুঁকি কমানো সম্ভব পুলিশের একটি নির্দেশনা মেনে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে স্থানীয় থানায় ভাড়াটেদের তথ্য দিতে যে ফরম ছাড়া হয়েছে, নানা ঘটনার পর সেখানে এখন গৃহকর্মীর তথ্য দেয়ারও নিয়ম করা হয়েছে। তবে এই তথ্য দেয়ার প্রবণতা একেবারেই কম।

গৃহকর্মীর হাতে রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষের হত্যার মামলার রায়েও বিচারক গৃহশ্রমিকদের ছবি, পরিচয়পত্র, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা থানায় জমা দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এর পরেও অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।

মোহাম্মদপুরে এক বাড়িওলা বলেন, ‘থানা থেকে ওভাবে প্রেশার দেয়া হয় না। আমরা ফরম দিয়ে দেই ভাড়াটিয়াদের। তারা গৃহকর্মীদের তথ্য না দিলে আমরা কী করতে পারি? নিজের ভালো কেউ না বুঝলে তাকে কে বোঝাবে?’

মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক মো. মোরশেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিটি বাসার বাড়িওলাদের কাছে নিবন্ধন ফরম দেয়া আছে। নতুন ভাড়াটিয়া আসলে এই ফর্ম পূরণ করে আমাদের কাছে দিয়ে যান। এই ফর্মে গৃহকর্মী ও ড্রাইভারের পরিচয়ের জন্য দুটি যায়গা আছে। যারা স্থায়ী গৃহকর্মী ও ড্রাইভার রাখেন তারা ফরমের ওই ঘরগুলো পূরণ করে দেয়ার কথা। তবে তারা এটা পূরণ করে দিচ্ছে কি না এটা আমরা জানি না।’

তিনি বলেন, ‘গৃহকর্মী রাখার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য আমার কাছে নাই। শুধু কাজের মহিলা রাখছে এ রকম তথ্য কেউ আমাদের দিচ্ছে না। তথ্য যদি কেউ আমাদের না দেয়, তবে আমাদের কী করার আছে?’

শের-ই-বাংলা থানার উপপরিদর্শক জহিরুল ফিরোজ বলেন, ‘স্থায়ী গৃহকর্মীর পরিচয়পত্র ও ছবি থানায় জমা দেয়ার নিয়ম। সে যদি কোনো বাজে ঘটনা ঘটায় তখন তাকে খুঁজতে সহায়তা করে এই পরিচয়পত্র। যারা সচেতন তারা দিয়ে যান, বাকিরা দেন না। অস্থায়ী গৃহকর্মীদের কোনো তথ্যই থানায় দেয়া হয় না।’

ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী পারভীন হত্যার রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘সম্প্রতি রাজধানীতে গৃহকর্মী সেজে প্রতারণার ঘটনা প্রায় ঘটেছে। তারা বিভিন্ন বাসা-মেসে কাজ করার নামে সুযোগ বুঝে কৌশলে টাকা-পয়সা, মোবাইল, স্বর্ণালংকার ইত্যাদি চুরি এবং পরিবারের সদস্যদের অজ্ঞান ও হত্যা করে মালামাল নিয়ে যায়।’

রায়ে আদালত কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক করে দেয়। এর মধ্যে আছে, ১. নিয়োগের তারিখ থেকে ৯০ দিন সতর্ক থাকা; ২. গৃহকর্মীদের জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি ও জীবনবৃত্তান্ত থানায় জমা দেয়া; ৩. বাসার ফটকে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন; ৪. কোনও গৃহকর্মী যদি অন্য কোনও গৃহকর্মীকে কাজ দেন তাহলে দুই জনেরই জীবনবৃত্তান্ত, ছবি সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেয়া; ৫. গৃহকর্মী দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স থাকা।

২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিজ বাড়িতে খুন হন ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী। গত ৪ অক্টোবর এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে অধ্যক্ষের বাসার দুই গৃহপরিচারিকা রেশমা আক্তার ওরফে রুমা ও রীতা আক্তার ওরফে স্বপ্নার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয় আদালত।

রায়ে বলা হয়, ২০১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মাহফুজাকে খুন করে জিনিসপত্র লুটের পরিকল্পনা করে আসামিরা। পরের দিন টাকা, সোনার অলঙ্কার ও মোবাইল ফোন সেট নিয়ে পালিয়ে যান তারা।

শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে আইনি কাঠামো তৈরির দাবি উঠেছে বিভিন্ন সময়। ছবি: সংগ্রহীত

উল্টোচিত্রও আছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ১১ বছর বয়সী গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ উঠে গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্তার বিরুদ্ধে। ঘটনার চার মাস পর দুই জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

২০২০ সালের জুলাইয়ে ১২ বছর বয়সী এক গৃহকর্মীকে ব্যাপক মারধর করার অভিযোগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহযোগী অধ্যাপক ও তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গৃহশ্রমিককে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের বিষয়টি প্রায়শই আসে গণমাধ্যমে। এমনও দেখা যায়, ঘটনার অনেক পরে তা অভিভাবকরা জানতে পারে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র দুই বছর আগের এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে, গৃহশ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় অর্থ ও চাপের মুখে সমঝোতা করা হয়৷ গৃহকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা দরিদ্র হওয়ায় তারা মামলা মোকদ্দমায় যেতে চান না বা যেতে সাহস পান না৷

এমনকি হত্যা মামলা টাকায় মীমাংসার ঘটনাও ঘটেছে।

ধুঁকছে গৃহকর্মী নিয়োগ দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো

এখন পর্যন্ত গৃহশ্রমিক নিয়োগের পদ্ধতিতে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেই আছে। পরিচিত গৃহশ্রমিক বা ঘরের দারোয়ানের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে কাউকে নিয়োগ করা হয়।

তবে সম্প্রতি বিভিন্ন সংস্থার অ্যাপে নিবন্ধন করে গৃহশ্রমিক ভাড়া নেয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে এসব সংস্থাও থানায় তথ্য দেয় না।

অনেক কোম্পানি আবার বন্ধ করে দিয়েছেন তাদের এই সেবা। কারণ হিসেবে তারা বলছে, কাজে গিয়ে নানা অপকর্মের কারণে তাদের দুর্নাম হয়, কিন্তু তারা ব্যবস্থা নিতে পারেন না।

‘হ্যালো টাস্ক’ নামে একটি গৃহকর্মী সরবরাহের অ্যাপ আছে। তারা বাসায় অস্থায়ী গৃহকর্মী সেবা দিয়ে থাকেন। কল সেন্টারের মাধ্যমে তারা তথ্য দিয়ে থাকে।

তাদের কল সেন্টারে কথা বললে সেখান থেকে একজন বলেন, সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত এই সেবা দেয়া হয়। এই সেবায় গৃহকর্মীরা কাজ করে চলে আসবেন। তারা স্থায়ীভাবে বাসায় থাকবেন না।

তিনি বলেন, এই গৃহকর্মীদের জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবিসহ সব তথ্য সংস্থার কাছে জমা থাকে। কোনো গৃহকর্মী যদি কোনো অনৈতিক কাজ করে থাকেন, তবে এর সকল দায়ভার নেবে সংস্থাটি।

তবে সংস্থাটি তাদের সেবাগ্রহীতাদেরকে বলে দেন যে, গৃহকর্মী গৃহে প্রবেশ ও ত্যাগের আগে তাদের চেক করতে হবে।

‘সহকারী ডট কম’ নামে আরেকটি উদ্যোগের অপারেশন এক্সিকিউটিভ ম্যানেজার নিপুঞ্জ রোজারিও বলেন, গৃহকর্মীদের সকল তথ্য কোম্পানির কাছে থাকে। চাইলে কোম্পানি দেবে। তবে তারা গৃহকর্মীদের তথ্য থানায় জমা দেন না।

ধানমন্ডি থানার উপপরিদর্শক পলাশ বিশ্বাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমি দেখি নাই কোনো সংস্থাকে থানায় এসে জমা দিতে।’

গৃহকর্মী সরবরাহের উদ্যোগ নিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন মো. সোহেল নামে একজন। কারণ হিসেবে জানান, গৃহকর্মীরা বাসাবাড়ি থেকে চুরি করে চলে যাওয়ার কারণে তাকে বিপাকে পড়তে হয়েছে। তাই এই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।

নানা ঝামেলার কারণে এই সেবা চালু করে বন্ধ করে দিয়েছেন কাজী মাসুদ নামে আরও একজন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঘরের সেবা নামে আমাদের সার্ভিস ছিল। আমরা স্থায়ী গৃহকর্মী দিতাম। কিন্তু এই সব গৃহকর্মীদের মধ্যে অনেকে নানা ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তাছাড়া ক্লায়েন্টদের বিরক্ত করত। অনেক সময় গ্রাহকদের কথা শুনত না।

‘এক মুরুব্বি মহিলাকে গৃহকর্মী হিসেবে একটা পরিবারের কাছে দিয়েছিলাম। ওই বাসার গৃহকর্তী ছিলেন সন্তান সম্ভাবা। চন্দ্রগ্রহণের সময় গৃহকর্তীকে তিনি বলতেন, এ সময় শুয়ে থাকলে মরা বাচ্চা হবে। তাকে কিছু বললে বলতেন, তার ১২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি হয়েছে। তিনি সেখানে থাকবেন না।’

এমনও সংস্থা আছে যারা একবার গৃহকর্মী বুঝিয়ে দিয়ে আর খোঁজ নেয় না।

এমনই একটি প্রতিষ্ঠান ‘বন্ধন সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজ’। তাদের কাছ থেকে সেবা নিয়ে বিপদে পড়া একজন লিপি রানি সাহা।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘তাদের কাছ থেকে আমি একজন স্থায়ী গৃহকর্মী নেই। ছয় মাসের চুক্তিতে সংস্থাটি আমার কাছ থেকে ছয় হাজার টাকা অগ্রিম নেয়। আর গৃহকর্মীকে দেয়া লাগত মাসে ছয় হাজার টাকা।

‘আমার বাচ্চা হওয়ার দেড় মাস আগে তিনি আমার বাসায় আসেন। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই তিনি চলে যান। সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা আমার অগ্রিম টাকা ফেরত দেয়নি এবং টাকা চাওয়ার কারণে খারাপ ব্যবহার করে।

‘গৃহকর্মী কিছু জিনিস চুরি করেন। এই বিষয়টা আমি সংস্থাকে জানালে তারা এরও কোনো ব্যাবস্থা নেয়নি।’

এ বিভাগের আরো খবর