চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতির বড় নাম এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। সিটি করপোরেশন গঠনের পর চট্টগ্রামে এই প্রথম ভোট হচ্ছে যখন আর বেঁচে নেই তিনি।
টানা তিনবার মেয়র নির্বাচিত হওয়া এই আওয়ামী লীগ নেতা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মারা যান। তবে চট্টলাবাসী তাকে যে ভুলে যায়নি, সেটা ভোটের প্রচারেই স্পষ্ট।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক নেতাদের কণ্ঠে প্রায়ই উঠছে মহিউদ্দিন চৌধুরী নাম। নির্বাচনি প্রচার বা গণসংযোগের তারা প্রয়াত মেয়রের কথা বলেই ভোট চেয়েছেন।
চট্টগ্রামের সন্তান আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিনি চট্টগ্রামের রাজনীতির একজন প্রবাদপ্রতীম মানুষ ছিলেন। তিনি শুধু আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন তা নয়, তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে বার বার বিজয়ী মেয়রই শুধু নন, তিনি চট্টগ্রামে বাংলাদেশের রাজনীতির একজন অথরিটি ছিলেন।’
চট্টগ্রামের প্রতিটি উন্নয়নে, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন বিপ্লব বড়ুয়া। বলেন, ‘চট্টগ্রামের মানুষ মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বার বার রেফারেন্স হিসেবে নিয়ে আসছে। উনার শূন্যতা আমরা সবসময় অনুভব করি। আমাদের সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সেটা সবসময় অনুভব করে। শুধু আওয়ামী লীগের নয়, এই এলাকার সকল দলের, সকল মানুষের কণ্ঠস্বর ছিলেন।’
১৯৯৪ সালে প্রথম নির্বাচন হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে। সেবার বিএনপির প্রার্থী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীনকে হারিয়ে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন মহিউদ্দিন। ২০০০ ও ২০০৫ সালে চট্টগ্রামবাসীর সমর্থনে টানা বিজয় পান তিনি।
তবে ২০১০ সালে বিএনপি–সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলমের কাছে ধরাশায়ী হন মহিউদ্দিন। আর সবশেষ নির্বাচন অর্থাৎ ২০১৫ সালে তাকে আর মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। দলের সমর্থন যায় আ জ ম নাছির উদ্দীনের কাছে। মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।
আড়াই দশক ধরে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং আ জ ম নাছিরের কাছে। যদিও তাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল, ছিল কোন্দল। যা একেবারেই প্রকাশ্য ও স্পষ্ট।
মহিউদ্দিন বেঁচে না থাকলেও এখনও সেই দূরত্ব ঘুচেনি আজও। তার অনুসারীরা এখনও বেশ সক্রিয়। তার প্রতিফলন এবারের মেয়র নির্বাচন। যেখানে বদলে গেছে সব হিসেব নিকেশ। মনোনয়ন চেয়েও ব্যর্থ হন নাছির।
চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে আওয়ামী লীগ তার প্রতীক নৌকা তুলে দিয়েছেন রেজাউল করিম চৌধুরীর হাতে। যা চমকে দেয় চট্টগ্রামবাসীকে। তবে রাজনীতিতে সজ্জন হিসেবে পরিচিত আড়ালে থাকা এই মানুষটিকে চট্টগ্রামবাসী বলছেন মহিউদ্দিনের অনুসারী।
মেয়র নির্বাচন নিয়ে দৃশ্যত কোনো কোন্দল নেই। কিন্তু কাউন্সিলর পর্যায়ে সেটা তীব্র আকার ধারণ করেছে। দলের কঠোর নির্দেশনাও মানছেন না প্রার্থীরা।
চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার কাউন্সিলরর পদে মহিউদ্দিনের ১৭ জন অনুসারী পেয়েছেন দলের সমর্থন। বিপরীতে নাছিরের অনুসারী পেয়েছেন মাত্র আটটি ওয়ার্ডে। আর গেল পরিষদের ১৭ কাউন্সিলরকে মনোনয়নই দেয়নি আওয়ামী লীগ।
তাদের পাঁচজন দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও ১২ জন কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। বিদ্রোহী সবাইকে নাছিরের অনুসারী বলছে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা।
এমন পরিস্থিতি নিয়ে আক্ষেপ করলেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সুজন।
এখানেই মহিউদ্দিন চৌধুরীর শূন্যতা টের পাওয়া যায় বলে মনে করেন তিনি।
মহিউদ্দিন চৌধুরী বেঁচে থাকলে বিরাজমান এই সংকটগুলো থাকত না বলেও মনে করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের এই নেতা।
তিনি বলেন, ‘আজকে আমাদের যে অনেকগুলো প্রবলেম হচ্ছে, বিভিন্ন কাউন্সিলর, অমুক তমুকসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইয়ে (জটিলতা) আছে। উনি থাকলে, সেখান থেকে অনেক সহজে উত্তরণ করা যেত।’
সুজন বলেন, ‘তিনি (মহিউদ্দিন চৌধুরী) ছিলেন আমাদের ওপর একটা ছায়ার মতো। মহানগর আওয়ামী লীগের পুরো অস্তিত্বকে ঘিরে উনি ছিলেন। উনার অনুপস্থিতিটা, উনার যে দক্ষতা, উনার যে নির্বাচন পরিচালন প্রক্রিয়া সেখান থেকে আওয়ামী লীগ কর্মীরা বঞ্চিত হয়েছে।’
তবে এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বললেন চট্টগ্রামের আরেক নেতা শাহাজাদা মহিউদ্দিন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মিস করি তো অবশ্যই। মহিউদ্দিন চৌধুরী তো মহিউদ্দীন চৌধুরী।…মহিউদ্দিন ভাই চলে গেছেন, তার অভাব পূরণ হবে না। কিন্তু কেউ না কেউ তো এই শূন্যতা পূরণ করবে যতটুকু সম্ভব।’
তবে যতটুকু প্রচার-প্রচারণা হয়েছে নৌকার বিজয়ের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করেন তিনি।