রাজশাহী নগরীর ভদ্রা এলাকার এক কিশোর ‘নিখোঁজ’ হয় গত ৮ অক্টোবর। পরে পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকার মুক্তিপণ চেয়ে ফোন আসে।
সে একটি প্রতিষ্ঠিত পরিবারের ছেলে। বয়স ১৪। ওই কিশোরের বাবা থানায় সাধারণ ডায়েরি করে পুলিশের সাহায্য চান।
পুলিশ মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে জানতে পারে, ওই কিশোর আশপাশেই আছে।
অভিযান চালিয়ে পুলিশ কয়েকজনকে আটকও করে। দুইদিন পর ১০ অক্টোবর রাতে ওই কিশোর বাড়ি ফিরে।
সে অসুস্থতার ভান করে। হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক জানান, তার কিছুই হয়নি।
পরে পুলিশ জানতে পারে, পরিবারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা নেয়ার জন্য ছেলেটি নিজেই অপহরণ নাটক সাজিয়েছিল।
এ ঘটনায় পুলিশ ওই কিশোরের কয়েকজন বন্ধুকে আটক করে অভিভাবকদের ডেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়।
এমন ঘটনা ঘটছে মাঝে মধ্যেই। গত এক মাসে অন্তত দুইটি সাজানো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী মহানগরে।
এর আগের ছয় মাসে আরও অন্তত পাঁচটি সাজানো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বিভ্রান্তিতে পড়ছে পুলিশ। অনেক সময় অনেক কষ্ট করে আর সময় নষ্ট করে তদন্ত শেষে পুলিশ জানতে পারছে ঘটনাটি ভুয়া।
গত ১৮ জুন ভিভো মোবাইল শোরুমে ছিনতাই ঘটনা সাজান সেখানকার দুই কর্মচারী।
ভিভোর শোরুমের জন্য নতুন কিছু ফোন নিতে ওই দিন ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ার কথা ছিল। শোরুমের মালিক অঞ্জন কুমার রায় তার কর্মচারী মেহেদী হাসান এবং সিম্ফনির পরিবেশকের ম্যানেজার সোহেলকে টাকাগুলো ব্যাংকে জমা দিতে পাঠান।
শোরুম থেকে ডাচ বাংলা ব্যাংকে হাঁটা দূরত্বেই তিন-চার মিনিটের পথ। কিছুক্ষণ পর মেহেদী নামে কর্মচারী প্রচার করেন, তার টাকা ছিনতাই হয়ে গেছে।
ঘটনার বর্ণনা দেন মেহেদী। বলেন, শোরুম থেকে টাকা নিয়ে বের হয়ে তারা যখন হাঁটা শুরু করে তখন দুই যুবক মোটরসাইকেল নিয়ে এসে মেহেদীর কাঁধে থাকা ব্যাগটি টান দিয়ে নিয়ে চলে যান।
ঘটনার পর পুলিশ তদন্ত শুরু করে বুঝতে পারে এই ঘটনাও সাজানো। প্রায় ৩৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করতে তারা ছিনতাইয়ের নাটক সাজিয়েছিলেন।
পুলিশ নিশ্চিত হওয়ার পর গ্রেপ্তার করে মেহেদীসহ তিন জনকে। ছিনতাই হওয়া ৩৩ লাখ টাকার মধ্যে উদ্ধার হয় ৩২ লাখ টাকা।
আপন ভাইয়ের ১৭টি সোনার বার আত্মসাৎ করতে এক ছিনতাইয়ের নাটক সাজিয়েও ধরা পড়েছেন আরও এক জন। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তারও করেছে।
তার নাম জিতেন ধর। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার জামনগর গ্রামে তার বাড়ি। পুলিশ তার কাছ থেকে ১৬টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে। একটি বার ধরা পড়ার আগেই বিক্রি করে দেন তিনি।
গত ২১ ডিসেম্বর রাজশাহী মহানগরীর শিরোইল এলাকায় এই ছিনতাই নাটক সাজানো হয়। এ নিয়ে স্বর্ণের মালিক দ্বিজেন ধর নগরীর বোয়ালিয়া থানায় মামলা করেন। নিশ্চিত হয়ে পরদিনই বোয়ালিয়া থানা পুলিশ জিতেন ধরকে গ্রেপ্তার করে।
জিতেনের বড় ভাই দ্বিজেন ধর ফেনীতে থাকেন। ২১ ডিসেম্বর তিনি ফেনারী দুটি জুয়েলার্স থেকে ১৭টি স্বর্ণের বার নিয়ে রাজশাহীর পুঠিয়ায় ভাই জিতেনের বাড়ি আসেন। তার ভাই জিতেনকে বারগুলো রাখতে দেন। প্রতিটি বারের ওজন ১০ ভরি। ১৭ বারের মূল্য প্রায় এক কোটি ১২ লাখ ৭১ লাখ টাকা।
জিতেন একজন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। তিনি এই স্বর্ণের বারগুলো আত্মসাতের পরিকল্পনা করেন।
দ্বিজেন তার ভাই জিতেনকে সঙ্গে নিয়ে রাজশাহী শহরে জুয়েলার্সের দোকানে স্বর্ণের বার বিক্রি করতে যান। ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে জিতেন আগে থেকেই ছিনতাইয়ের নাটক সাজিয়ে আসেন।
জিতেন ও দ্বিজেন নগরীর শিরোইল এলাকায় পৌঁছামাত্র হঠাৎ দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে চারজন ব্যক্তি এসে নিজেদের ‘প্রশাসনের লোক’ পরিচয় দেন। তাদের কাছে থাকা হ্যান্ডকাপ দেখান। তারা জিতেনের কাছে থাকা ব্যাগটি জোর করে কেড়ে নেয়। ছিনিয়ে নেয় মানিব্যাগ এবং দুটি মুঠোফোনও।
পরে পুলিশ জানতে পারে, জিতেনের তার পরিকল্পনা অনুযায়ী মিজানুর রহমান মিজান ও মৃদুল নামে দুই ব্যক্তি পুঠিয়া থেকেই বাসের পেছনে পেছনে মোটরসাইকেল নিয়ে আসেন। তারা ব্যাগ ছিনতাইয়ের জন্য শহরে অন্য তিনজনকে মোটরসাইকেল নিয়ে প্রস্তুত রাখেন।
জিতেন ও দ্বিজেন বাস থেকে নামলেই সে তথ্য অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দেন মিজান ও মৃদুল। এরপরই ব্যাগ কেড়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
তবে স্বর্ণগুলো জিতেনের বাড়িতেই ছিল। সেখান থেকে একটি বার জিতেন বিক্রি করে দেন। তাকে গ্রেপ্তারের সময় বাড়ি থেকে বাকি ১৬টি বার উদ্ধার করে পুলিশ।
সম্প্রতি নূরে হাবিব ডুজন নামের এক ব্যক্তি থানায় গিয়ে অভিযোগ করলেন, তার ছয় লাখ টাকা ছিনতাই হয়েছে। তিনি মামলাও করলেন।
তবে পুলিশের একদিনের তদন্তেই বেরিয়ে আসে- নূরে হাবিব মিথ্যা বলেছেন।
নূরে হাবিব নগরীর ভদ্রা জামালপুর এলাকার বাসিন্দা। তার বাবার নাম মৃত হাবিব উদ্দিন। তিনি ১১ জানুয়ারি নগরীর বোয়ালিয়া থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন, ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তার টাকা ছিনতাই হয়েছে।
বোয়ালিয়া থানা থেকে সামান্য দূরেই মোটরসাইকেলে আসা দুই যুবক তার টাকার ব্যাগ নিয়ে গেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। ঘটনার সময় তিনিও শপিং ব্যাগে টাকা নিয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে যাচ্ছিলেন বলে দাবি করেন।
নূরে হাবিব মামলায় বলেন, ঘটনার দিন তিনি প্রিমিয়ার ব্যাংকের রাজশাহী নগরীর আলুপট্টি শাখা থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন।
তবে পুলিশ ব্যাংকটির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে নূরে হাবিবকে পায়নি। এমনকি ব্যাংক থেকে কোনো টাকা তোলা হয়নি বলে কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানায়।
ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানায়, নূরে হাবিবের ব্যাংক হিসাবে আছে মাত্র ৮৩ টাকা। এতেই প্রমাণিত হয় যে নূরে হাবিবের কথা অসত্য।
এরপর নূরে হাবিবকে থানায় দীর্ঘ সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক পর্যায়ে তিনি পুলিশের কাছে স্বীকার করেন যে ছিনতাইয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
তিনি লিখিতভাবে পুলিশকে জানান, তার বড় ভাই রওশন আলী আমেরিকা প্রবাসী। তার ডিপিএস থেকে তিনি ছয় লাখ টাকা তুলে খরচ করে ফেলেছেন। প্রিমিয়ার ব্যাংকের ঢাকার শ্যামলী শাখায় তার ডিপিএস ছিল। সে ডিপিএস থেকে বিভিন্ন সময় টাকা তোলার কারণে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ছয় লাখ টাকা কেটে নিয়েছে। নূরে হাবিব তার ভাইয়ের টাকা তাকে না জানিয়ে খরচ করে দেয়ায় তিনি ছিনতাই নাটক সাজান।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘এসব ছিনতাইয়ের সাজানো ঘটনা পুলিশের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। তবে যে কোনো ঘটনা আমাদের কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।’