মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ৬৬ হাজারেরও বেশি ভূমিহীন পরিবারকে বিনা পয়সায় ঘর তুলে দিতে পারার দিনটিকে নিজের জন্য আনন্দের দিন হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শনিবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে ৬৬ হাজার ১৮৯টি গৃহহীন পরিবারের হাতে ঘর তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। তার সঙ্গে এ সময় যুক্ত ছিলেন ৪৯২টি উপজেলার সহায় সম্বলহীন মানুষ, যাদের হাতে দেয়া হচ্ছে মুজিববর্ষের এই উপহার।
অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে আমার জন্য একটা আনন্দের দিন। কারণ এ দেশের যারা সবচেয়ে বঞ্চিত মানুষ, যাদের কোনো ঠিকানা ছিল না, ঘরবাড়ি নেই আজকে তাদের অন্তত একটা ঠিকানা, মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে পারছি। এ দেশের মানুষের জন্যই কিন্তু আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংগ্রাম করেছেন।
‘আমাদের কথা কখনও চিন্তা করেননি। চিন্তা করেছেন বাংলার মানুষের কথা। যে মানুষগুলি ক্ষুধায় অন্ন জোগাতে পারত না, এক বেলা খেতে পারত না, যাদের কোনো থাকার ঘর ছিল না, রোগে চিকিৎসা পেত না তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। নিজে কী পেলেন না পেলেন সেটা নিয়ে চিন্তা করেননি।’
দ্রুততম সময়ে ঘরগুলো তৈরি করায় প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ধন্যবাদও জানান বঙ্গবন্ধু কন্যা।
‘এত দ্রুত সময়ে পৃথিবীর কোনো দেশে কিংবা আমাদের দেশেও কোনো সরকার এতগুলি ঘর করেনি। এটা কম কথা না। যারা প্রশাসনে আছেন, আপনারা সরাসরি ঘরগুলো তৈরি করেছেন সে কারণেই এটা করা সম্ভব হয়েছে এবং ঘরগুলো মানসম্মত হয়েছে।’
মাগুরায় ঘর পেয়েছে ১১৫টি পরিবার। ছবি: নিউজবাংলা
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রত্যেকটা শ্রেণির মানুষের জন্যই আমরা কাজ করে যাচ্ছি যেন সবাই মানসম্মতভাবে বাঁচতে পারে। মুজিববর্ষে আমাদের লক্ষ্য, একটি মানুষও ঠিকানাবিহীন থাকবে না, গৃহহারা থাকবে না। যতটুকু পারি, হয়তো আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু যা হোক একটা ঠিকানা আমি সমস্ত মানুষের জন্য করে দেব।’
এ সময় জাতির পিতার স্বপ্নের কথা তুলে ধরে তার কন্যা বলেন, ‘কারণ আমি বিশ্বাস করি, যখন এই মানুষগুলো এই ঘরে থাকবে, আমার বাবা-মা যারা সারাটা জীবন ত্যাগ স্বীকার করেছে এ দেশের মানুষের জন্য তাদের আত্মা শান্তি পাবে। লাখো শহিদ রক্ত দিয়ে দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তাদের আত্মা শান্তি পাবে।
‘এ দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করাই তো ছিল আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একমাত্র লক্ষ্য। কাজেই আজকে আমি সব থেকে খুশি যে এত অল্প সময়ে এতগুলি পরিবারকে আমরা ঠিকানা দিতে পেরেছি।’
এ সময় নিজ হাতে জমির দলিল তুলে দিতে না পারার আফসোস প্রকাশ পায় তার কণ্ঠে।
সহায় সম্বলহীন মানুষদের ভিটে বাড়ি দিতে পারায় আনন্দিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খুব আকাঙ্ক্ষা ছিল, নিজে আপনাদের হাতে জমির দলিল তুলে দিই। কিন্তু করোনার জন্য হলো না। তারপরেও আমি মনে করি, দেশ ডিজিটাল হয়েছে বলেই এভাবে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমরা প্রত্যেক শ্রেণির জন্য কাজ করছি। সব মানুষকেই ঠিকানা করে দেব, এটাই আমার লক্ষ্য।
দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোথাও কোনো ভূমিহীন কেউ থাকলে তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে ঘর করে দিতে হবে। ভূমিহীন কেউ থাকবে না।’
এ কাজে বিত্তশালীদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘এক দিনে এত মানুষকে ঘর দিতে পারলাম এটাইতো বড় পাওয়া। যার কিছু নেই তাকে ঠিকানা করে দেয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। বিত্তশালীরাও খুঁজে দেখতে পারেন। অসাধ্য সাধন আমরা করতে পারলাম। আমাদের এ মানসিকতা যেন অব্যাহত থাকে। দেশের মানুষের জন্য কিছু করা এর চেয়ে বড় আর কিছু হতে পারে না।
মুজিববর্ষে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন ঘোষণার ধারাবাহিকতায় ৬৬ হাজার ১৮৯টি ঘরের মালিকানা দেয়া হলো গৃহহীন ও ভূমিহীনদের হাতে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পছন্দ করা নকশায় নির্মাণ করা হয়েছে প্রতিটি ঘর। প্রতিটি ঘরে থাকছে দুটি শয়ন কক্ষ, একটি লম্বা বারান্দা, একটি রান্নাঘর ও একটি টয়লেট। এসব ঘরের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা। পরিবারগুলোর কর্মসংস্থানেরও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
তারা শুধু ঘর নয়, সঙ্গে পাচ্ছেন ভূমির মালিকানাও। প্রত্যেককে তার জমি ও ঘরের দলিল নিবন্ধন ও নামজারিও করে দেয়া হচ্ছে। দেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে এর আগে এত মানুষকে এক দিনে সরকারি ঘর হস্তান্তর করা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বিশ্বে এর আগে এক দিনে এত বেশি ঘর বিনা মূল্যে হস্তান্তর করা হয়নি।
ঘরগুলোর আশেপাশে বাগান গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
মুজিববর্ষে যারা ঘর পেয়েছেন তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা ঘর পেয়েছেন তারা এর আশেপাশে অন্তত একটা করে গাছ লাগান। বাগান করেন, ফল ও সবজি চাষ করেন। পুকুরগুলো কেটে মাছের চাষ করেন এবং সেগুলো বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করবেন।’
কী পেলাম না পেলাম সেটা বড় কথা না
পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে দেশে ফেরার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘পঁচাত্তরের পর দীর্ঘ ছয় বছর দেশে আসতে পারিনি। কারণ তখন যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল, জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতা দখল করে তখন থেকেই আমাদের দেশে আসতেই দেবে না।
‘এমনকি আমার ছোট বোনের পাসপোর্টটা পর্যন্ত রিনিউ করতে দেয় নাই। আমাকে যখন আওয়ামী লীগ, আমার অবর্তমানে দলের সভাপতি নির্বাচিত করে, আমি একরকম জোর করে, শুধু মানুষের কথা ভেবে, মানুষের শক্তি নিয়ে দেশে ফিরি। আমার কেউ ছিল না। আমার কোনো থাকার ঘরও নাই, কোথায় গিয়ে উঠব তাও আমি জানি না। আমি কীভাবে চলব তাও আমি জানি না।’
পিতার আদর্শ বাস্তবায়নই নিজের লক্ষ্য জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার কেবলই একটা কথা মনে হচ্ছিল আমাকে যেতে হবে। যেতে হবে এ কারণে, এই যে মিলিটারি ডিক্টেটরদের দ্বারা নিষ্পেশিত হচ্ছে আমার দেশের মানুষ, তাদের মুক্তি দিতে হবে, তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
‘তাদের জন্য কাজ করতে হবে আর এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে হবে যা আমার বাবা চেয়েছিলেন। একটি আদর্শ সামনে নিয়েই কিন্তু আমি ফিরে আসি। আমার লক্ষ্য একটাই সামনে ছিল, যে আমি কী পেলাম না পেলাম সেটা বড় কথা না, কিন্তু দেশের মানুষের জন্য কতটুকু কী করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি সারা বাংলাদেশ ঘুরি, দেখেছি মানুষের কষ্ট, দুঃখ, হাহাকার। পেটে খাবার নেই, ছিন্ন কাপড়, কঙ্কালসার দেহ, দুর্ভিক্ষ লেগেই আছে। বাংলাদেশে এমন অবস্থা ছিল যে বিদেশ থেকে পুরানো কাপড় নিয়ে এসে তাদের পরতে দেয়া হতো। এমন দুর্ভাগ্যে তারা পড়েছিল, কিন্তু এমন দুর্ভাগ্যে তো পড়ার কথা ছিল না।
‘জাতির পিতা তো সব পরিকল্পনাই নিয়েছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, তার পরিকল্পনা যখনই বাস্তবায়ন শুরু করলেন, তখনই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এগুলো বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের মানুষ বহু আগেই উন্নত জীবন পেত।’
গণতান্ত্রিক অধিকারটা কী?
নিজের বক্তব্যে সাবেক সেনা শাসক জিয়াউর রহমানের তীব্র সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ কী পেয়েছিল তখন? অনেকে গাল ভরে কথা বলে গণতান্ত্রিক অধিকার পেয়েছে। গণতান্ত্রিক অধিকারটা কী?
‘একটা মিলিটারি ডিক্টেটর ক্ষমতা দখল করে একদিন ঘোষণা দিলো যে আজ আমি রাষ্ট্রপতি হলাম, তার পরেই সেটা গণতন্ত্র হয়ে গেল। হ্যাঁ, অনেকগুলি রাজনৈতিক দল করার সুযোগ করে দিলো। কিন্তু মানুষকে দুর্নীতি করা, মানি লন্ডারিং করা, ব্যাংকে ঋণ খেলাপি করা, টাকা ব্যাংক ছাপিয়ে নিয়ে এসে এগুলি ছড়িয়ে দিয়ে মানি ইজ নো প্রবলেম, সে কথা শোনানো এবং আই ইউল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ান একথাও জিয়াউর রহমান বলে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের কাজই ছিল এদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলা। এদেশের মানুষকে দরিদ্র থেকে দরিদ্র রাখা। আর মুষ্টিমেয় লোকদের টাকা পয়সা দিয়ে তাদেরকে তার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। মেধাবী ছেলেদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের বিপথে ঠেলে দেয়া। নির্বাচনের নামে প্রহসন সৃষ্টি করা।
‘যারা গণতন্ত্রের জন্য এত কথা বলেন, তাদের কাছে একটাই প্রশ্ন, এটা কী করে গণতন্ত্র? একটা দল হলো, হাঁটতে চলতেও শিখল না।...দেশের মানুষকে কীভাবে শোষণ করা যায়, অধিকার কেড়ে নেয়া যায় তাই চলেছে ২১ বছর। জিয়ার পরে এরশাদ এসেছে, খালেদা জিয়া এসেছে, প্রত্যেকেরই একই চরিত্র।’
আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ করে দেয়ায় জনগণকে ধন্যবাদও জানান সরকার প্রধান। তিনি বলেন, ‘আমি ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশের জনগণকে। শত প্রতিকুলতার মধ্যেও এদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন।
‘আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিলেন বলেই ১৯৯৬ এ আমরা ক্ষমতায় আসতে পারি। জনগণই আন্দোলন করে খালেদাকে ক্ষমতা থেকে সরায়। আমাদের অগ্রাধিকার ছিল খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা। এরপর ২০০১ থেকে ২০০৮ আমাদের জন্য ছিল অন্ধকার যুগ। ২০০৮ এর নির্বাচনে আবার জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিলো। সেদিন জনগণের ভোট পেয়েছিলাম বলেই থমকে থাকা প্রকল্পগুলো আবার শুরু করতে পারি।’