আকাশপথে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে ঢাকাকে কেন্দ্র করেই ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে দেশি এয়ারলাইন্সগুলো। কিন্তু এবার পরিবর্তন আসছে এ ধারায়। অপ্রচলিত রুটে ফ্লাইট আনছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমানসহ বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে এয়ারলাইন্সগুলোর বহরে থাকা উড়োজাহাজের সক্ষমতার অনেকটাই ব্যবহার করা যাবে। তবে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলোতে রিফুয়েলিং সুবিধা ও ২৪ ঘণ্টা ফ্লাইট ওঠানামার সুযোগ তৈরি না করা গেলে সহজ হবে না পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।
দেশে প্রচলিত ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট মানেই ঢাকার সঙ্গে বিভিন্ন শহরের যোগাযোগ। কোনো যাত্রী যদি সৈয়দপুর থেকে চট্টগ্রাম যেতে চান, তাকে যেতে হয় ঢাকা হয়েই। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট যাত্রীকে প্রথমে সৈয়দপুর থেকে আসতে হয় ঢাকায়। এরপর ঢাকা থেকে ট্রানজিট নিয়ে উঠতে হয় চট্টগ্রামগামী উড়োজাহাজে। কোনো কোনো সময় ট্রানজিটে সময় লাগে ৩-৪ ঘণ্টা।
অথচ সৈয়দপুর থেকে ঢাকায় আসতে আকাশপথে সময় লাগে প্রায় ৪০ মিনিট। আর ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যেতে আরও প্রায় ৪০ মিনিট। অর্থাৎ এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে কখনও সময় লেগে যায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। তার উপর যাত্রার ধকল তো আছেই।
দেশি এয়ারলাইন্সগুলো এবার ঢাকা বাদ দিয়েই বিভিন্ন শহরকে আকাশপথে যুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এরই মধ্যে সিলেট থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ফ্লাইট শুরু করেছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোকাব্বির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের বহরে যে ড্যাশ-এইট উড়োজাহাজগুলো রয়েছে, এগুলো আঞ্চলিক দূরত্বে উড়তে সক্ষম। কিন্তু আমাদের দেশের গন্তব্যগুলোর ফ্লাইং আওয়ার বেশ কম। কম দূরত্ব হওয়ায় এই উড়োজাহাজগুলোর পূর্ণ সক্ষমতা আমরা ব্যবহার করতে পারছি না।
‘আমরা ট্র্যাডিশনাল বাদ দিয়ে নন-ট্র্যাডিশনাল রুটে ফ্লাইট শুরু করেছি। যেমন চট্টগ্রাম-সিলেট-কক্সবাজার আমরা শুরু করেছি। এখন আমরা যশোর-চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম-সিলেটও শুরু করব।’
দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করতে বিমান ব্যবহার করে ড্যাশ-এইট মডেলের উড়োজাহাজ। আর ইউএস বাংলা এবং নভোএয়ার ব্যবহার করে এটিআর সেভেনটি টু। দুই ধরনের উড়োজাহাজই স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে চলাচলের উপযোগী।
ড্যাশ-এইটের কানাডিয়ান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোম্বার্ডিয়ারের তথ্য অনুযায়ী, একবার জ্বালানি পূর্ণ করে ৬৬৭ কিলোমিটার বেগে ২৭ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়াল দিলে এটি সর্বোচ্চ পাড়ি দিতে পারে ২ হাজার ৪০ কিলোমিটার।
অন্যদিকে, ফ্রান্সের তৈরি এটিআর সেভেনটি টু পূর্ণ জ্বালানিতে ৫১০ কিলোমিটার বেগে ২৫ হাজার ফুট উচ্চতায় ছুটতে পারে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬৫ কিলোমিটার। তবে আসন পূর্ণ থাকলে এটি যেতে পারে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯৫২ কিলোমিটার।
অর্থাৎ পূর্ণ জ্বালানিতে ড্যাশ এইট উড়তে পারে সর্বোচ্চ প্রায় ৩ ঘণ্টার কিছু বেশি সময়। আর এটিআর সেভেনটি টু উড়তে পারে প্রায় চার ঘণ্টা। তবে আসন পূর্ণ অবস্থায় উড়তে পারে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা।
নতুন বছরে যশোর থেকে চট্টগাম ও কক্সবাজার, সৈয়দপুর থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং সিলেট থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার রুটে ফ্লাইট শুরুর পরিকল্পনা করছে বেসরকারি ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স।
ইউএস বাংলার বিপণন ও জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের যে কানেক্টিং ফ্লাইটগুলো রয়েছে, সেগুলোর এভেইলেবিলিটিরও একটি বিষয় রয়েছে। একই দেশে ভ্রমণ করার জন্য অনেক সময় দুই বার ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। আমরা যদি শহরগুলোকে যুক্ত করতে পারি তাহলে এ সমস্যা আর থাকবে না।
‘আগামী এপ্রিলে তিনটি নতুন এটিআর সেভেনটি টু মডেলের উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এগুলো চলে আসলেই নতুন এ রুটগুলোতে ফ্লাইট শুরু করা হবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারকে বিমানবন্দরগুলোতে বিভিন্ন সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশি এয়ারলাইন্সগুলোর নন ট্র্যাডিশনাল ফ্লাইটের কারণে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন যাত্রীরা। তবে এর জন্য বিমানবন্দরগুলোতে কিছু সেবা বাড়াতে হবে বলে মত তাদের।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও এভিয়েশন অপারেটস এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এটিএম নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমত সমস্যা হলো জ্বালানি। এটা যদি প্রত্যেক বিমানবন্দরে না পাওয়া যায়, তাহলে অতিরিক্ত জ্বালানি বহন করতে হবে। এতে ফ্লাইটে যাত্রী বহন ক্ষমতার সাথে কম্প্রমাইজ করতে হবে।
‘এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পদ্মাকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় পদ্মা যদি জ্বালানি সরবরাহ করে, তাহলে এটার সম্ভাবনা ভালো। সুবিধা হবে যাত্রীদের। তারা সরাসরি এক শহর থেকে আরেক শহরে যাতায়াত করতে পারবেন।’
বর্তমানে দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজের জ্বালানি সরবরাহ রয়েছে। এগুলো হলো ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেটের ওসমানি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। দেশের কোনো অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরেই জ্বালানি সরবরাহ নেই। এর জন্য এয়ারলাইন্সগুলোকে নির্ভর করতে হয় এই তিন বিমানবন্দরের উপরই।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এয়ারলাইন্সগুলোর এখন যে ক্যাপাসিটি আছে, সবক্ষেত্রেই তারা সেটি পূর্ণ ব্যবহার করতে পারছে না। এ ধরনের ফ্লাইট চালু হলে তারা তাদের সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে।
‘আমাদের যে বিমানবন্দরগুলো রয়েছে, এর মধ্যে শুধু ঢাকায় ২৪ ঘণ্টা ফ্লাইট চলাচল করতে পারে। বাকিগুলোর কোনোটিতেই ২৪ ঘণ্টা ফ্লাইট ওঠা-নামার সুযোগ নেই। এটি নিশ্চিত করা গেলে নিশ্চিতভাবেই এ রুটগুলো অনেক জনপ্রিয় হবে। এতে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে যাত্রীদের। সময়ের সাথে তাদের টাকাও বাঁচবে।’