করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে বহুল আকাঙ্ক্ষিত টিকার প্রথম চালান বাংলাদেশে এসেছে। দিনক্ষণ ঠিক করা হলেই শুরু হবে প্রয়োগ।
ভারত সরকারের উপহার হিসেবে সিরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ২০ লাখ ডোজ বৃহস্পতিবার দেশে আসে।
বেলা ১১টা ২০ মিনিটে টিকা বহনকারী বিশেষ বিমানটি রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।
বিমানবন্দর থেকে দুটি ফ্রিজার ভ্যানে টিকা তেজগাঁওয়ের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) সেন্টারে রাখা হয়। সেখানেই টিকার ডোজগুলো বিশেষ ফ্রিজারে সংরক্ষণ করা হবে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ডা. রওশন জাহান আক্তার আলো।
তিনি বলেন, ‘টিকাগুলো দুই থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এখানে সংরক্ষণ করা হবে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আমরা শক্তভাবে মেনটেইন করছি। টিকা সংক্ষরণ ও বিতরণে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। সব মিলিয়ে সর্বমোট ১৬৭টি কার্টনে করে ভ্যাকসিনের ডোজ এসে পৌঁছেছে।
‘প্রতি কার্টনে আছে ১২০০ ভায়াল ভ্যাকসিন। এক ভায়ালে ১০ জনকে টিকা দেওয়া যাবে। ২০ লাখ চার হাজার ডোজ ভ্যাকসিন এসেছে।’
ইপিআইয়ের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মওলা বক্স চৌধুরী জানান, বিমানবন্দর থেকে আনার সময় সঠিক তাপমাত্র নিয়ন্ত্রণ করে টিকা আনা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিভিন্ন জেলায় সঠিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সংরক্ষণ ও বিতরণ করা হবে।
গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভির মাধ্যমে আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ফাইজারের টিকা দেয়ার প্রস্তাব রয়েছে। ফাইজারের টিকা ইপিআরে সংরক্ষণ করা যাবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মওলা বক্স বলেন, ‘পরের চালানের বিষয় পরে বলা যাবে।’
তেজগাঁওয়ের ইপিআই ভবন থেকে দুপুর ১টা ৪২ মিনিটে কিছু টিকা বাক্সে ভরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় নেয়া হয়। ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের হাতে তুলে দেন একটি বাক্স। তাতে আঁকা ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকা।
ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের হাতে টিকার বাক্স তুলে দেন। ছবি: পিয়াস বিশ্বাসপাশে দাঁড়ানো ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক ও কর্মকর্তারা।
এরপর উপস্থাপকের ঘোষণায় মাইকের সামনে দাঁড়ান ভারতীয় হাইকমিশনার। তিনি বলেন, গত শনিবার ভারত সরকার টিকা দেয়া শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার তা ঢাকায় এসে পৌঁছেছে।
টিকা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী। ছবি: পিয়াস বিশ্বাসতার পরে মাইক তুলে নেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতিবেশী নীতিরই বহিঃপ্রকাশ বাংলাদেশের জনগণের জন্য এই মহামারির মধ্যে পাঠানো ২০ লাখ ডোজ টিকা উপহার। ভারত বাংলাদেশকে করোনার টিকা দিয়ে প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ তাদের পরম বন্ধু।
‘ভারত ১৯৭১ সালে যেমন আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, টিকা দিয়ে এই মহামারিতেও তেমনি দাঁড়িয়ে বন্ধুত্বের প্রমাণ রেখেছে।’
বাংলাদেশকে পাঠানো ২০ লাখ ডোজ করোনার টিকা উপহার হিসেবে দেয়াকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার সম্পর্কের গভীরতার নির্ণায়ক বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।
টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা দেখতে বিকেল ৩টার সময় রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ইপিআই সেন্টার পরিদর্শনে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
টিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা দেখতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ইপিআই সেন্টারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ছবি: তবিবুর রহমানওই সময় তিনি বলেন, ‘২০ লাখ টিকা আমাদের হাতে আছে। এই মাসে আরও ৫০ লাখ টিকা আসবে। তখন আমাদের হাতে ৭০ লাখ টিকা থাকবে।’
তিনি জানান, চুক্তি অনুযায়ী আগামী ছয় মাসের প্রতিটিতে ৫০ লাখ ডোজ করে টিকা দেবে ভারত।
মন্ত্রী বলেন, ‘টিকা দেয়ার দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয় নাই। যদি কেউ কোনো ডেট (তারিখ) বলে থাকে তা নিছকই গুজব।
‘আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি ডেট চেয়েছি। তিনি সময় দিলেই আমরা কর্মসূচি চূড়ান্ত করব।’
স্বাস্থ্যসচিব আবদুল মান্নান বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২৭ বা ২৮ জানুয়ারি টিকা প্রয়োগ শুরু করতে চান তারা। তবে এই তারিখও এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে টিকাদান উদ্বোধনের কথা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন। প্রথমে যে টিকা দেয়া হবে, তা হবে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ।
ঢাকা মেডিক্যাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে প্রাথমিকভাবে এই টিকা দেওয়া হবে বলে জানান স্বাস্থ্যসেবা সচিব আবদুল মান্নান।
টিকা প্রথম দেয়া হবে ২০ থেকে ২৫ জনকে। চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাংবাদিকদের মধ্যে থেকে তাদের বাছাই করা হবে।
বিশ্বের অনেক দেশে করোনা প্রতিরোধী টিকার প্রথম ডোজটি নিয়েছেন সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা। কিন্তু ভারতের মতো বাংলাদেশেও তা হচ্ছে না।
সরকার মনে করছে, করোনা মোকাবিলায় যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, টিকা প্রদানে তাদেরই অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।
টিকা নেয়ার পর কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কি না তা পর্যবেক্ষণ করা হবে বলেও জানান আব্দুল মান্নান।
তিনি আরও জানান, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে চিকিৎসা দেয়া হবে।