মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে শুরু হবে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।
শুরুতে তালিকা যাচাই করে ৪১ হাজার ৭১৯ জনকে ফিরিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছে মিয়ানমার।
বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় চীন সরকারের দেয়া দুই হাজার ৫৫৪ মেট্রিক টন চালের হস্তান্তর অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী এ কথা জানান।
এর আগেও প্রত্যাবাসান প্রক্রিয়ার কথা বললেও তার বরখেলাপ করেছে মিয়ানমার। দুই বার উদ্যোগ নিয়েও একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
এবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে চীন। মিয়ানমারের ওপর এই দেশটির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
মঙ্গলবার ঢাকায় চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। ভার্চুয়াল এই বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার লুও ঝাওহুই অংশ নেন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে আলোচনায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার লুও ঝাওহুই
বৈঠকের বিষয়ে চীনা দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়, ফেব্রুয়ারিতে তিন দেশের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক হবে। এরপর হবে সচিব পর্যায়ের বৈঠক আর মার্চ মাস নাগাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক।
এরপর মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফর করবে। বাংলাদেশের প্রস্তাব অনুযায়ী, গ্রাম বা অঞ্চলভিত্তিক ভাগ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে।
প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কতটা সফল হতে পারে প্রশ্ন রাখা হয় ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীর কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তেমনি মিয়ানমারের সঙ্গেও তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। মিয়ানমারের উন্নয়নে চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সে জায়গায় চীন যদি সত্যিকারভাবে চায় তাহলে অবশ্যই মিয়ানমার সরকারকে তারা প্রভাবিত করতে পারবে।’
চীন ও মিয়ানমারের সঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে সব ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমার রিয়ালাইজ করেছে তাদের (রোহিঙ্গাদের) ফিরিয়ে নেয়া দরকার। বাংলাদেশ ফিল করে তারা (রোহিঙ্গা) সম্মানের সঙ্গে নাগরিক অধিকার নিয়ে ফিরে যাক। চাইনিজ গভর্নমেন্ট চায়, বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বার্থে তাদের ফিরে যাওয়া উচিত।’
চীন সত্যিকারভাবে কী সেটা চাইছে আবারও প্রশ্ন রাখা হয় প্রতিমন্ত্রীর কাছে। উত্তরে প্রতিমন্ত্রী জানালেন, ‘গতকালের মিটিং থেকে আমরা যে বক্তব্য পেয়েছি তাতে মিয়ানমারও বর্তমানে ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। তারা নিয়ে যাবে। যে তালিকাগুলো বাংলাদেশ সরকার ভেরিফাই করে পাঠিয়েছে, সেখান থেকে তারা যে ভেরিফাই করেছে, সে সংখ্যায় তারা নিয়ে যাবে।’
মন্ত্রী বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আট লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা তৈরি করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়। সেই তালিকা থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাড়ে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার নাম মিয়ানমারের কাছে পাঠায়। তবে মিয়ানমার যাচাই বাছাই করে আপাতত ৪২ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিচ্ছে।
তবে এটাই চূড়ান্ত কিছু নয় জানিয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব বললেন, ‘মিয়ানমারে তালিকা যাচাই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। প্রত্যাবাসান প্রক্রিয়ার শুরু হলে তালিকা যাচাইয়ের কাজ গতি পাবে।’
এই আলোচনাকে চলমান প্রক্রিয়া জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আশা করি, পরবর্তী মিটিংয়ের আরও ভালো সমাধান আসবে।’
‘গতকালের মিটিংয়ে চীন, মিয়ানমারের যে সদিচ্ছা আমরা দেখেছি, সবাই আশা করেছেন মার্চ- এপ্রিলের মধ্যেই হয়তো রেপেট্রিয়েশনটা শুরু হবে। আমরা সেই ভাল ফলাফলের অপেক্ষায় আছি।’
চীনকে বাংলাদেশের ‘পরীক্ষিত এবং বিশ্বস্ত বন্ধু’ উল্লেখ করে এনামুর বলেন, ‘আমাদের জাতীয় উন্নয়নে চীনের অনেক অবদান রয়েছে। বিশেষত পদ্মা সেতুর কথা বলতে হয়, যা প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আমরা খুবই খুশি যে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীন আমাদের পাশে রয়েছে।’
রোহিঙ্গারা ৮০ দশক থেকেই প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আসতে থাকে। তবে সবচেয়ে বড় স্রোতটা আসে ২০১৭ সালের আগস্টের পর। সব মিলিয়ে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এদের মধ্যে এক লাখকে বাংলাদেশ ভাসানচরে স্থানান্তর করতে চায়। এরই মধ্যে দুই বারে দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে সেখানে নেয়া হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক। এ জন্য দেশটির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে মিয়ানমার পিছিয়ে আসে আর এ নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ নানাভাবেই বিরক্তি প্রকাশ করছে।
মিয়ানমারের ওপর চীনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে এবং সাম্প্রতিক উদ্যোগে এই দেশটি যুক্ত হওয়ায় ঢাকা এবার প্রত্যাবাসন শুরুর ব্যাপারে আগের চেয়ে বেশি আশাবাদী।