গরীব দুস্থ মানুষের ভাতা নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্মের অবসান হচ্ছে। এখন থেকে মোবাইলে ভাতা পাবেন দেশের প্রায় ৮৮ লাখ মানুষ।
ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৃহস্পতিবার সকালে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা জি টু পি পদ্ধতিতে বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এখন থেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিভিন্ন ভাতা গ্রহীতারা সরাসরি তাদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাবেন। এতে তাদের ভোগান্তি অনেকটাই কমবে বলে আশা করছে সরকার।
বর্তমানে সারা দেশে ৪৯ লাখ জন বয়স্কভাতা, ২০ লাখ ৫০ হাজার জন বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, ১৮ লাখ জন অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ও এক লাখ জন পাচ্ছেন প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি।
তবে কাজ করার সক্ষমতা থাকলে শুধু ভাতার ওপর নির্ভরশীল না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘কেউ শুধু ভাতার ওপর নির্ভরশীল হোক এটা আমরা চাই না। ভাতা পাবে, কিন্তু যার কর্মক্ষমতা আছে সে নিজে কিছু কাজও করবে। একেবারে ঘরে বসে থাকবে না।
‘সেটা হিসাব করেই অন্তত যেন ১০ কেজি চাল কিনতে পারে, সে হিসেবে আমরা ভাতা দেয়া শুরু করি। তখন ১০ টাকায় এক কেজি চাল পাওয়া যেত। তাই আমরা একশ টাকা করে ভাতা দেয়া শুরু করি। এখন সেটা আমরা বাড়িয়েছি। এখনতো প্রায় ৫শ টাকা করে সবাই ভাতা পাচ্ছেন। আবার গ্রহীতার সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।’
ভাতা দেয়ার ফলে নানা সামাজিক অসঙ্গতি দূর হচ্ছে বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘কোনো নারী যখন পারিবারিক সংঘাত বা বিধবা বা স্বামী ছেড়ে দেয়ার ফলে কাজের খোঁজে শহরে আসে। এক পর্যায়ে শিশুগুলি ভবঘুরে হয়ে যায়, পথশিশু হয়ে যায়।
‘সামাজিক এ অবিচারের হাত থেকে রক্ষা করতেই আমরা এই স্বামী পরিত্যক্তা বা বিধবাদের ভাতা প্রচলন করি। আমি জানি তাদের হাতে নগদ টাকা থাকলে সংসারের অন্য সদস্যরা তাদের স্থান দেবে। অনেক সামাজিক সমস্যাও দূর হবে।’
আমার সরকার মানেই জনগণের সেবক
প্রধানমন্ত্রীত্বকে কেবল মানুষের সেবা করার মাধ্যম হিসেবেই দেখেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেন, ‘আমার সরকার মানেই জনগণের সেবক।’
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার দিনই মানুষের জন্য কাজ করার পণ করেছিলেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেদিনই বলেছিলাম দেশের মানুষের সেবক হিসেবে কাজ করব। প্রধানমন্ত্রীত্ব আর কিছু না, আমার কাছে এটা, আমি কাজ করার সুযোগটা পাচ্ছি।
‘কাজ করার ক্ষমতাটা পাচ্ছি। কাজেই মানুষের জন্য কাজ করব, মানুষের সেবা করব। আমার সরকার মানে মানুষের সেবক। এই সেবক হিসেবেই কাজ করতে চাই।’
টানা ক্ষমতায় থাকায় উন্নয়ন
সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রাখার কারণেই বারবার ক্ষমতায় এসেছেন বলে জানান শেখ হাসিনা। বলেন, ‘আমি কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের জনগণের প্রতি, তারা আমাদের বারবার ভোট দিয়েছে। আমাদের ওপর আস্থা রেখেছে, বিশ্বাস রেখেছে।
‘এ কারণে সেবা করার সুযোগ পেয়েছি। আর এভাবে একটানা ক্ষমতায় থাকার কারণে আমরা উন্নয়নটা করতে পারছি মানুষের জন্য।’
এ সময় দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠনের প্রেক্ষাপটও উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে যখন ইমারজেন্সি দেয়া হলো। সবার প্রথমে কিন্তু আমাকেই গ্রেপ্তার করা হয়। আমি যদিও বিরোধী দলে ছিলাম। সাধারণত এমন হয় না। সরকার দলীয়দেরই আগে গ্রেপ্তার করা হয়।
‘তখন আমি ভাবতাম একদিন তো মুক্তি পাব। তখন কি করব। কোন সালে কোন কাজটা করব। এ সব চিন্তা করে লিখে রাখতাম। তারপর যখন ২০০৮ এ মুক্তি পেলাম। নির্বাচনের ইশতেহারে সে পয়েন্টগুলোই, যা যা তখন প্রয়োজন সেগুলো নিয়েই দিন বদলের সনদ আমরা ঘোষণা দেই। ২০২১ সালের মধ্যে দেশটাকে অন্তত ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করে গড়ে তুলব, সে লক্ষ্য নিয়েই কিন্তু আমরা পরিকল্পনা নিতে শুরু করলাম।’
২০২১ সালে কেউ গৃহহারা থাকবে না বলেও জানান সরকার প্রধান। এ কাজে সরকারের পাশাপাশি সামর্থবানদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্যটা হচ্ছে, যেহেতু জাতির পিতা এদেশের মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন, তাই তার জন্মশত বার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তিতে কোনো মানুষ গৃহহারা থাকবে না। যারা ভূমিহীন তাদের আমরা ভূমি দেব, ঘর দেব, প্রত্যেকের একটা ঠিকানা দেব। সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে আলো পৌঁছে দেয়া, শতভাগ বিদ্যুৎ দেয়া। যেন প্রতিটি ঘর আলোকিত হয়। সেভাবেই যেন মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন হয়। একই সঙ্গে প্রত্যেককে গাছ লাগাতে হবে। এক কোটিরও বেশি গাছ আমরা লাগিয়েছি, এ কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। শুধু সরকার না সামর্থবানরাও এগিয়ে আসতে পারেন।’
দেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মমত্ববোধ তুলে ধরে তার জ্যেষ্ঠ কন্যা বলেন, ‘দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো খুব কঠিন কাজ। এ কাজটাই তিনি করতে চেয়েছিলেন। নিজের জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন। নিজের ভবিষ্যতের দিকেও তাকান নি।
‘বারবার আঘাত এসেছে মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখেছেন। কিন্তু লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। ফাঁসির দড়িও তাকে টলাতে পারেনি। আমার পিতার কাছ থেকেই সে শিক্ষা, দেশকে ভালোবাসতে আমরা শিখেছি। বাংলাদেশের মানুষই ছিল তার কাছে সবচেয়ে বড়।’
সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু গ্রামে উন্নয়ন পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘তিনি ক্ষমতায় বসে মুষ্টিমেয় মানুষকে অর্থশালী-সম্পদশালী করতে চাননি। তিনি সারাদেশের সমাজ ব্যবস্থাটাকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন।
‘যেকোনো দেশে স্বাধীনতা বা বিপ্লবের পরে একটা বিবর্তন আসে। বিবর্তনের ফলে অনেক মানুষ অনেক সময় পথ হারিয়ে ফেলে। অনেকে অর্থ বিত্তের দিকে ছোটে। যে আদর্শ বা লক্ষ্য নিয়ে সংগ্রাম অনেক সময় মানুষ সেটা ভুলে যায়। এ কারণে তিনি সমস্ত জিনিসটাকে ঢেলে নতুন করে সাজাতে চেয়েছিলেন। তার এ পরিবর্তন শহরকেন্দ্রিক ছিল না, তিনি গ্রাম পর্যায়ে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন।’
বক্তব্যের পর চাঁদপুর, পিরোজপুর, লালমনিরহাট ও নেত্রকোণায় যুক্ত হন শেখ হাসিনা। এ সময় ভাতাভোগীদের সাথে কথাও বলেন সরকার প্রধান।