রাজধানীর ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী অনন্যা (ছদ্মনাম)। মায়ের সঙ্গে সামান্য বিষয়ে কথা কাটাকাটির জেরে গভীর রাতে নিজের বাসা ছেড়ে চলে যান পছন্দের কিশোরের বাসায়। অনন্যাকেও পরিবারটি খুব সহজেই গ্রহণ করে।
ওই রাতেই শারীরিক সম্পর্কে জড়ান দুই কিশোর-কিশোরী। তবে এরপর তৈরি হয় অনুতাপ। সকালে কেঁদে কেটে মায়ের কাছে ফেরেন তিনি। এরপর দুই পরিবার মিলে বিষয়টিকে সহজ করার চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। তিন মাসেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি অনন্যা। অপরাধ মানসিকতা নিয়ে এই কিশোরী এখন নিয়মিত যাচ্ছেন কাউন্সিলরের কাছে।
রাজধানীর একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ১৬ বছরের আরেক কিশোরীর সন্ধান পেয়েছে নিউজবাংলা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার পরিচয় হয় এক যুবকের সঙ্গে।
মেয়েটির বাবা-মা দুজনই চাকরিজীবী। করোনায় স্কুলও বন্ধ থাকার সুযোগে এই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। ফেসবুক মেসেঞ্জারে একান্ত ব্যক্তিগত ছবি ওই যুবককে নিয়মিত পাঠাতে শুরু করেন মেয়েটি।
এরপর গত ১৯ ডিসেম্বর পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে ধানমন্ডির একটি বাসায় যান মেয়েটি। সেখানে ওই যুবকসহ তিনজন জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করে তার সঙ্গে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে দুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাও নিতে হয় মেয়েটিকে।
মেয়েটির পরিবারের সদস্যরা জানান, এরপর থেকে মানসিক ট্রমায় ভুগছেন ওই কিশোরী। একপর্যায়ে মেয়েটিকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেন বাবা-মা। সেখানে মনোবিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হন মেয়েটি, তবে ভাষাগত জটিলতায় খুব একটা ফল মেলেনি। তাই এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই অনলাইনে দেশের চিকিৎসকদের মাধ্যমে চলছে চিকিৎসা।
যৌনতা সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে কাজ করছে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যৌনাচার এবং এর মাধ্যমে তৈরি হওয়া সমস্যার মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে।
কমিউনিটিভিত্তিক মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান লাইফস্প্রিং যৌনতাকেন্দ্রিক হতাশা ও মানসিক সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের কাউন্সিলিংসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের গত তিন বছরের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, সেবাগ্রহীতাদের ৩০ শতাংশ অপ্রাপ্ত বয়স্ক, যাদের বেশিরভাগই কিশোরী। মেয়েদের ২০ শতাংশ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত।
সরকারি মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেও পাওয়া যাচ্ছে একই ধরনের তথ্য।
কিশোর-কিশোরীর গোপন যৌনাচারের কারণ হিসেবে তিনটি প্রধান দিক সামনে আনছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হলো: ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি এবং সন্তানকে অভিভাবকের সময় না দেয়া।
যৌনতা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবেও কিশোর-কিশোরীরা নানান জটিলতায় পড়ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, জটিলতার শিকার কিশোর-কিশোরী বেশিরভাগ সময়েই সংকটের কথা অভিভাবকদের জানাতে পারছেন না। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে মনোচিকিৎসকের সাহায্য চাইছেন।
লাইফস্প্রিং এর কনসালট্যান্ট সাইকিয়াট্রিস্ট ডা. মুনমুন জাহান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক কিশোর-কিশোরী আমাকে মেসেঞ্জারে নক দিচ্ছে। বলছে, ম্যাম আপনি কেন আমার মেসেজের উত্তর দিচ্ছেন না? আমার গোপন সমস্যা আছে। কিন্তু আমি আমার পাবিবারকে বলতে পারছি না।’
সেবাপ্রার্থী অনেকের বয়স ১১ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে বলে জানান ডা. মুনমুন। তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ বাবা-মা তাদের সন্তানদের এসব সমস্যায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না।’
দেশের কিশোর-কিশোরীর মধ্যে পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি লাগামহীনভাবে বাড়ছে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন হতে তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
ঝুঁকিপূর্ণ যৌনাচারের জন্য সঠিক যৌন শিক্ষার অভাবকে দায়ী করছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার হেলাল উদ্দিন আহমেদ।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যৌন শিক্ষার অভাবে বিকৃত যৌনাচারের দিকে ঝুঁকছে শিশুরা। পারিবার বলেন বা সমাজ বলেন, বিজ্ঞানভিত্তিক যৌন শিক্ষার অনেক অভাব রয়েছে আমাদের দেশে।’
সুস্থ বিনোদনের অভাব ও শিথিল পারিবারিক বন্ধনকেও এসব অসঙ্গতির জন্য দায়ী করছেন এই অধ্যাপক।
‘আগের চেয়ে পারিবারিক বন্ধন অনেকটা কমে গেছে। শিশুরা বাবা-মায়ের সঙ্গে মানসম্মত সময় কাটাতে পারে না। এছাড়া অশ্লীলতা ও পর্নোগ্রাফি সহজলভ্যতার কারণে বিকৃত যৌনাচার বাড়ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুদের জন্য একটি শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পাঠ্যবইতে যদি যৌন শিক্ষা থাকত, তাহলে এই বিকৃত যৌনাচার বাড়ত না। সামাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক হতে হবে।
‘অভিভাবকরা এখন শিশুদের জিপিএ ফাইভ নিয়ে ব্যস্ত। এগুলো থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এজন্য সবাইকে সম্মলিতভাবে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।’
সংকট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কলাবাগানের ঘটনার প্রসঙ্গ টানেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক।
তিনি বলেন, ‘তারা (দিহান ও মেয়েটি) কিন্তু সুযোগ খুঁজছিল, যখন বাসা ফাঁকা পেয়েছে তখনই মেয়েটাকে ডেকে এনে জোর করে যৌনাচারে লিপ্ত হয়েছে। এমন কর্মকাণ্ড বাড়ার কারণ হলো- পরিবারগুলো যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সন্তানদের বড় করার চেষ্টা করছে, সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই একটা ত্রুটি রয়ে যাচ্ছে। পরিবারগুলো সন্তানদের নিজ দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গড়ে তুলতে পারছে না, তারা বিদেশি সংস্কৃতি নিয়ে বড় হচ্ছে।
‘মূল্যবোধের অভাবেই অন্য জেন্ডারের সঙ্গে সংবেদনশীল আচরণ করতে পারছে না। কলাবাগানের ঘটনাটি যে দেশে প্রথম ঘটনা, এটা বলা যাবে না। অথচ আমরা কোনো শিক্ষা নিতে পারিনি বা কোনো বার্তা দিতে পারিনি।’
এক্ষেত্রে পরিবার বা রাষ্ট্রকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মনে করছেন তৌহিদুল হক। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার ওপরও জোর দিচ্ছেন তিনি।
‘বিচারহীনতার কারণে একজন পুরুষ নারীকে ভোগের পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। এছাড়া আমাদের এখন সময় এসেছে যৌন শিক্ষার বিষয়টি সামনে আনার। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবইয়ে এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এই জায়াগাগুলোতে আমরা উন্নতি করতে না পারলে কখনও মুক্তি লাভ করা সম্ভব হবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যৌন শিক্ষা না থাকায় কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যৌনতা সম্পর্কে শিশুদের মধ্যে নানান ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে।
‘শিশুদের মধ্যে পর্নো আসক্তি বাড়ায় যৌনাচারে ঝোঁকার প্রবণতা বাড়ছে। সবচেয়ে বড় কথা, তরুণদের বিপদগামী হওয়ার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে মূল্যবোধের চর্চা বেশি দরকার। একইসঙ্গে যৌন শিক্ষাটা পাঠ্যবইয়ে আনতে হবে।’