নারায়ণগঞ্জে খুন না করেও কী কারণে আসামিরা ধর্ষণ করে হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়েছে, সে প্রশ্ন তুলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ভর্ৎসনা করেছে উচ্চ আদালত।
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ধর্ষণ ও হত্যার শিকার স্কুল ছাত্রীর জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় বিচারিক তদন্ত প্রতিবেদনের শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছে, ‘ফাঁসি হবে জেনেও আসামিরা কি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছে?’
তবে এ ঘটনাকে পুরো পুলিশ বাহিনীর গাঁয়ে মাখানোর দরকার নেই বলেও উল্লেখ করেছে আদালত। বিচারক বলেন, ‘বিছিন্ন ঘটনাকে বিছিন্নভাবেই দেখা উচিত। যদি কারও অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে তা থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটনো যায়, সেটা পুলিশ বাহিনীর ভেবে দেখা উচিত।’
বুধবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করে।
গত বছরের ২৪ আগস্ট ‘ধর্ষণের পর নদীতে লাশ ফেলে দেয়া স্কুল ছাত্রীর ৪৯ দিন পর জীবিত প্রত্যাবর্তন’ শীর্ষক শিরোনামে জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রচার হয়। ওই সংবাদ যুক্ত করে গত ২৫ আগস্ট হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করেন আইনজীবী শিশির মো. মনির।
২০২০ সালের ৪ জুলাই একটি কিশোরীকে অপহরণের অভিযোগ এনে মামলার পর পুলিশ রকিব, খলিল ও আব্দুল্লাহ নামে তিন জনকে গ্রেপ্তার করে।
তারা আদালতে মেয়েটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার কথা স্বীকার করেন। তবে গত ২৩ আগস্ট কিশোরীটিকে ফিরে পায় তার পরিবার।
বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা। জামিনে মুক্তি পেয়ে যুবকরা জানান, তাদেরকে রিমান্ডে পেটানো হয়েছে। নির্যাতন থেকে বাঁচতেই পুলিশের শিখিয়ে দেয়া কথা আদালতে বলেন।
- আরও পড়ুন: ‘লাশ’ ফিরলেও রেহাই নেই খলিল মাঝিদের
পরে জানা যায়, নির্যাতন না করার শর্ত দিয়ে তিন যুবকের স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুন। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে সে টাকা তিনি ফেরতও দিয়েছেন।
এই ঘটনায় পুলিশের তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়ের যে অভিযোগ আছে, সেটি আবার সামনে আসে। এই ঘটনায় চাকরি থেকে বরখাস্ত হন উপপরিদর্শক শামীম আল মামুন।
এই ঘটনার বিচারিক তদন্তের জন্য গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। ওই নির্দেশনার বিচারিক তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষের আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী আদালতকে বলেন, ‘বিচারিক তদন্ত কমিটির রিপোর্টে পুলিশ বাহিনীর ওপর একটা দোষ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরঞ্জিত কিছু করেননি। তিনি তার আওতার মধ্যে থেকেই আসামিদের গ্রেপ্তার করেছেন ও রিমান্ডে নিয়েছেন। আসামিদের কোনো নির্যাতন করা হয়নি। কারণ, আসামিরা জুডিশিয়াল কমিটির বাইরে আর কারও কাছে নির্যাতনের কথা তুলে ধরেননি।’
এ সময় আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, ‘জবানবন্দিতে আসামিরা যে বক্তব্য দিয়েছে সেটা সত্য নয়। ভিকটিমকে মেরে নদীতে ফেলার যে জবানবন্দি তাতে আসামিদের স্বার্থ কী? এ দেশের মানুষের জন্য ক্ষুদিরাম ফাঁসিতে ঝুলতে চেয়েছিল। এই জন্য কি সকলেই ফাঁসিতে যেতে চায়! এ বিষয়ে আমাদের একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে।’
- আরও পড়ুন: পুলিশের তদন্তে খুন, আদালতে হাজির ‘নিহত’
বিচারক বলেন, ‘আমরা বিচারপতি, আমরা এ মাটির সন্তান। আমরা সব কথা কোর্টে বলতে পারি না। এখানে সাংবাদিকরাও থাকেন। ফাঁসি হবে জেনেও আসামিরা কি স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছে? জবানবন্দিতে আসামিরা মেয়েটিকে হত্যা করার কথা কি শখ করে বলেছে? এটা দুর্ভাগ্যজনক। অভাগা তো হলো এ দেশের জনগণ।’
তখন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ভিকটিম বিচারিক কমিটির কাছে বলেছেন, আসামি আবদুল্লাহ তাকে ধর্ষণ করেছে।’
বিচারক বলেন, ‘২২ ধারার জবানবন্দিতে মেয়েটি আদালতে কী বলেছে? দুটো জবানবন্দির ভেতরে কোনটাকে আমরা ঠিক মনে করব?’
এ সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারোয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, ‘আসামিরা রিমান্ডের পর জবানবন্দি দিয়েছেন। ওই জবানবন্দি দেয়ার সময় তারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নির্যাতনের কথা বলে নাই।’
আদালত বলে, ‘আপনাদের দুইজনের শুনানি গ্রহণ করলে আসামিদের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য বলে ধরে নিতে হয়।’
আদালত বলে, ‘আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যদি পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায়ও যদি কোন ব্যক্তিকে কোনো কটূ কথা পর্যন্ত বলা হয় তাহলে সেটা অপরাধ হিসেবে দেখা হয়।’
আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা ভিকটিমকে উদ্ধার করেছেন। সে জন্য জুডিশিয়াল রিপোর্টে তার প্রশংসাও করা হয়েছে। এই মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক হবে না। তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক।’
এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনকে উদ্দেশ করে আদালত বলে, ‘ভারতে কোনো আসামিকে রিমান্ডে নেওয়া হলে সেখানে আইনজীবী রাখার সুযোগ আছে। সেজন্য তারা সিআরপিসি সংশোধন করেছে। আমরা তো কোর্ট থেকে আইন সংশোধনের কথা বললে নানা প্রতিক্রিয়া হয়।’
মনসুরুল হক চৌধুরী বাংলাদেশ বনাম ব্লাস্ট মামলার উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ‘এই মামলায় বলে দিয়ে রিমান্ডে আইনজীবী রাখার সুযোগ আছে।’
তখন অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এই মামলাটির রিভিউ বিচারাধীন রয়েছে। সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিল বিভাগকে এ বিষয়ে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
তখন আদালত বলে, ‘হাইকোর্টের কাজ কি তাহলে রুল মঞ্জুর, রুল খারিজ করা আর জামিন দেয়া?’
এ পর্যায়ে মামলার আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘ব্লাস্ট বনাম রাষ্ট্র মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যে রিভিউ চাওয়া হয়েছে সেখানে রিমান্ডে আইনজীবী রাখার বিষয়ে কোন বিরোধিতা করা হয়নি।’
পরে মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২০ জানুয়ারি বুধবার দিন ঠিক করে দেয় আদালত।
ওইদিন অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনবেন বলে মুলতবি করেন বিচারক।