বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বলাৎকার: সন্তানকে মাদ্রাসা থেকে স্কুলে

  •    
  • ৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০৮:৫৯

রুহুল আমীন নামের একজন বলেন, ‘স্বপ্ন দেখছিলাম ছোট ছেলেকে হেফজ মাদ্রাসায় ভর্তি করাব। কিন্তু বলাৎকারের ঘটনা এত বেশি বেড়ে গেছে যে, এখন আর ইচ্ছা করছে না।’

ফেনীতে একটি কওমি মাদ্রাসায় শিশুকে বলাৎকারের ঘটনায় বাবা তাকে সেখান থেকে এনে স্কুলে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ভুক্তভোগী বাবা জানান, ছাগলনাইয়া উপজেলার দারুল আরকান তাহফিজুল কুরআন মাদ্রাসায় তার ছেলেকে হেফজ বিভাগে ভর্তি করিয়েছিলেন।

ভর্তির এক মাসের মধ্যে শিশুটি জানায়, এক শিক্ষক তাকে বলাৎকার করেছেন। এরপর বাবা তার ছেলেকে মাদ্রাসা থেকে নিয়ে এসেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আর সেখানে পাঠাবেন না। স্কুল খুললে সেখানেই ভর্তি করবেন।আরও পড়ুন: বল দেয়ার কথা বলে বলাৎকার

ওই বাবা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আঁর (আমার) স্বপ্ন আছিল ছেলেরে কুরআনে হাফেজ বানামু। হেইডা আর হাইরলাম না। সরকার যদি নিয়ন্ত্রণ কইত্তে না হারে, তাইলে এইসব মাদ্রাসা এগান বন্ধ অই যাইব।’

মাদ্রাসায় এ রকম যৌন নির্যাতনের অভিযোগ পুরনো। এ নিয়ে সমাজে ফিসফাস থাকলেও প্রকাশ্যে আলোচনা হয়েছে কমই। তবে সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, সভা-সমাবেশে এ নিয়ে কথা উঠছে; তথ্যচিত্র প্রদর্শন হচ্ছে।আরও পড়ুন: মাদ্রাসায় এক মাসে ৪০ বলাৎকার

দেশে অপরাধ, নির্যাতন নিয়ে সারা বছর নানা ধরনের জরিপ প্রকাশ হলেও এতদিন মাদ্রাসায় কতসংখ্যক বলাৎকারের খবর গণমাধ্যমে আসে তা জানা যায়নি কেউ লিপিবদ্ধ না করায়।

তবে গত নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলো সংকলন করে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন জানতে পেরেছে, ওই ৩০ দিনে ৪০টি বলাৎকারের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে দুটি ঘটনায় মারা গেছে দুটি শিশু। একটি শিশু লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে।

সংগঠনটি বলাৎকারবিরোধী ব্যাপক প্রচারে নেমেছে। সম্প্রতি তারা রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদে ও মাদ্রাসায় বলাৎকারের সমস্যাটি নিয়ে লিফলেট বিতরণ করেছে।

যেভাবে মাদ্রাসা ছাড়ল আরেক শিশু

ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার আরেক কওমি ছাত্র বলাৎকারের সমস্যার কারণে মাদ্রাসা ছেড়েছে। পরিবার তাকে সেখানে যেতে জোরাজুরি করায় এক পর্যায়ে সে ঢাকায়ও পালিয়ে আসে।

১০ বছর বয়সী এই ছেলেটি রশিদপুর মদিনাতুল উলুম মাহমদিয়া সুলতানিয়া মাদ্রাসায় পড়ত। তার সঙ্গে কথা হয়েছে নিউজবাংলার।

ছেলেটি জানায়, মাদ্রাসায় এক শিক্ষকের বিকৃত যৌনাচারের শিকার হয়েছিল সে।

ছেলেটির বর্ণনা অনুযায়ী, ওই শিক্ষক একটি বই দেয়ার কথা বলে তার কক্ষে ডেকে নেন। প্রথমে তার কপালে ও পরে দুই গালে চুমো দেন। এক পর্যায়ে তার যৌনাঙ্গে হাত দেন। ছেলেটি অস্বীকৃতি জানালে তাকে ১০০ টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়।আরও পড়ুন: নিরাপদ মাদ্রারা চাই

বিষয়টি পরিবারের কাউকে প্রথমে জানায়নি ছেলেটি। তবে বাড়ি থেকে মাদ্রাসায় পাঠালে সেখানে না গিয়ে সে লুকিয়ে থাকত।

ছেলেটি জানায়, একপর্যায়ে বাবা-মা তার ফাঁকি দেয়ার কথা জেনে যান। তাকে আবার মাদ্রাসায় পাঠানোর চেষ্টা করলে ছেলেটি ঢাকায় চলে আসে।

পরিবার থানায় ছেলেটির নিখোঁজের তথ্য জানালে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ ফেনীতে পাঠায়। এরপর ছেলেটির কাছ থেকে সব জানতে পেরে তাকে আর মাদ্রাসায় পাঠায়নি পরিবার।আরও পড়ুন: ফিসফাস ছেড়ে বলাৎকার নিয়ে আওয়াজ

ছেলেটি বলে, ‘হুজুর আঁরে (আমাকে) নতুন বই দেয়ার কথা বলি তার রুমে লই যায়। আঁর কোয়ালে (কপালে) ছুমা দে। আঁই তখন কিচ্ছু ন কইলে দুই গালে ছুমা দেয়। কতক্ষণ পর আঁর পায়জোমা-পাঞ্জাবি খুলার চেষ্টা করে। খুলতে ন দিলে ১০০ টেঁয়া দিবো বলে। তবুও আই রাজি হইনু।

‘দুই দিন পর মাদ্রাসাতুন (মাদ্রাসা থেকে) বাড়িতে আইলে আর মাদ্রাসায় যাইতে চাইতাম না। আঁর মা-বাপ জোর করি হাডাইলে হলাই হলাই (পালিয়ে পালিয়ে) থাইকতাম। আঁর বাপ ধরি আনি আবার মাদ্রাসায় হাডাইত চাইলে আঁই একদিন ট্রেনে করি ঢাকা চলি যাই।’

এই ঘটনাগুলো অভিভাবকদের মধ্যে কতটা প্রভাব পড়েছে, তা দুই জনের মন্তব্যেই স্পষ্ট।

রুহুল আমীন নামে একজন বলেন, ‘স্বপ্ন দেখছিলাম ছোট ছেলেকে হেফজ মাদ্রাসায় ভর্তি করাব। কিন্তু বলাৎকারের ঘটনা এত বেশি বেড়ে গেছে যে, এখন আর ইচ্ছা করছে না।’আরও পড়ুন: বলাৎকার নিয়ে বক্তব্য কই, বাবুনগরীকে প্রশ্ন

হারুনুর রশীদ ফরহাদ নামে আরেক অভিভাবক বলেন, ‘হেফজ ও কওমি মাদ্রাসার পাঠদান আধুনিকায়ন করা দরকার। ছাত্র-শিক্ষক একসঙ্গে থাকার পদ্ধতি তুলে দিতে হবে। পাশাপাশি বলাৎকারের জন্য কঠোর আইন হওয়া দরকার।’

এ ধরনের ঘটনা বিরল নয়

ফেনীর বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের আরও একাধিক ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে।

অভিযুক্তরা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এমন নজির কম; বরং ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাই করা হয়।

জেলার ছয়টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গেই কথা হয়েছে নিউজবাংলার। তারা জানান, অভিযোগ উঠার পর কোনো মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাদের খবর দিয়েছে বা সন্দেহভাজনদের ধরিয়ে দিয়েছে, এমন নয়।

বলাৎকারের শিকার এক ছাত্র জানিয়েছে, সে তিন জন শিক্ষকের যৌনাচারের শিকার হয়েছে। তার ধারণা, সব শিক্ষক এমন করে। তাই সে ভয়ে ‘বড় হুজুরকে’ অভিযোগ দেয়নি।আরও পড়ুন: মাদ্রাসায় বলাৎকার নিয়ে মসজিদে লিফলেট

গত ৭ ডিসেম্বর ফেনীর দাগনভূঞায় এক মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে শিক্ষক এমদাদ উল্যাহকে আটক করে পুলিশ।

থানায় জমা দেয়া অভিযোগে বলা হয়, এমদাদ শিশুটিকে দেড় মাসে একাধিকবার বলাৎকার করেছেন। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

ওই ছাত্র মাদ্রাসায় যেতে না চাইলে মায়ের চাপাচাপিতে সব খুলে বলে। এরপর মা অভিযোগ দেন থানায়।

কিছু আলোচিত ঘটনা

থানায় যত অভিযোগ জমা পড়েছে, তাতে দেখা যায় বেশির ভাগ ছাত্রের বয়স পাঁচ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে।

অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা মাদ্রাসায় অভিযোগ না দিয়ে তাদের বাবা-মাকে খুলে বলে। কোনো রকম বাড়িতে যেতে পারলে আবার মাদ্রাসায় ফিরে যেতেও চায় না।

গত বছরের ২৩ এপ্রিল দাগনভূঞা উপজেলায় আবদুর রহমান নামে এক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

সে সময়ও একটি শিশুকে মাদ্রাসায় যেতে বলা হলে সে যেতে চাইছিল না। পরিবার চাপাচাপি করলে সে কান্নাকাটি শুরু করে। তখন জিজ্ঞাসাবাদে সে পুরো ঘটনা খুলে বলে। পরে শিশুটির বাবা পুলিশকে অভিযোগ করেন।আরও পড়ুন: বলাৎকারের অপবাদ আমাদের কেন: ইসলামী আন্দোলন

ওই বছরের ১৫ এপ্রিল দাগনভূঞায় মাদ্রাসার শিক্ষক শহীদুর রহমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে।

শিশুটি মাদ্রাসার আবাসিক ছাত্র ছিল। সে ছুটিতে বাড়ি আসার পর আর ফিরতে চাইছিল না। একপর্যায়ে কান্নাকাটি শুরু করে। পরে সে সব খুলে বলে। আর পরিবারটি অভিযোগ দেয় থানায়।

সোনাগাজী উপজেলা নবাবপুর ইউনিয়নের মাদরাসাতু ওসমান (রা.) মাদ্রাসায় হিফজ বিভাগের ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগ উঠার পর খাদেম নুর ইসলাম কৌশলে পালিয়ে গেছেন।

একই মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আব্দুল ফাত্তাহর বিরুদ্ধে তিন ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগ ওঠার পর গত ১৫ আগস্ট তিনি পালিয়ে যান।

গত বছরের ১৯ জানুয়ারি মতিগঞ্জের সাতবাড়িয়া হেফজ মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে একটি শিশু বাড়ি চলে আসে। সেখানে সে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে শিশুটি জানায় তাকে বলাৎকারের কথা।

পরদিন তারা মাদ্রাসায় এসে পরিচালনা পর্ষদের কাছে অভিযোগ করে শিশুটির পরিবার। কিন্তু সন্দেহভাজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।আরও পড়ুন: ‘ভাস্কর্য নিয়ে ভাবতে হবে না, বলাৎকার বন্ধ করুন’

গত ২০ ও ২৯ জুলাই রাতে ছাগলনাইয়ার দারুল আরকান তাহফিজুল কুরআন মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের দুই ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগ উঠে। করোনার শুরুতে মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়ার পর তারা বাড়ি ফেরে।

মাদ্রাসা খোলার পর তারা যেতে অস্বীকার করে। তখন তাদের ওপর হওয়া নির্যাতনের কথা প্রকাশ করে।

ফেনীর পুলিশ সুপার খোন্দকার নুরুন্নবী বলেন, ‘ছেলে শিশু ধর্ষণ হলেও আমরা সমান গুরুত্ব দিয়ে আসামিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসি। ঘৃণিত এসব ঘটনা শোনামাত্রই আমরা অভিযুক্তদের আইনের আওতায় নিয়ে আসি। তবে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মনে করে অনেকে গোপন রাখার চেষ্টা করেন।’

তিনি বলেন, ‘অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে। মেয়ের পাশাপাশি ছেলেদের ব্যাপারেও বাড়তি নজরদারি রাখতে হবে।’

ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজজামান বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনা খুবই নিকৃষ্ট মানের। এটি আসলে শক্ত হাতে দমন করা না হলে একসময় ধর্মীয় শিক্ষা থেকে মানুষ বিমুখ হয়ে যাবে।’

এ বিভাগের আরো খবর