নাটোরে এক কলেজছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠার পর সন্দেহভাজনকে পুলিশে না দেয়ার বদলে তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীকে বাঁচাতে নানা চেষ্টার অভিযোগ উঠছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে।
হাতিয়ান্দহ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ ইসমাইল হোসেন মেয়েটির পরিবারটিকে প্রলুব্ধ করে দেড় লাখ টাকায় মীমাংসার চেষ্টা করেন বলে স্বীকারও করেছেন।
তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ ও শিক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, অধ্যক্ষ এটা করতে পারেন না। পুলিশ বলেছে, যারা মীমাংসার চেষ্টা করেছে, আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে তাদের বিরুদ্ধেও। স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, অধ্যক্ষ এই কাজ করলে তারাও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবেন।
মেয়েটির পরিবার নিম্ন আয়ের। তিনি স্থানীয় একটি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়েন।
ডিসেম্বরের শেষ দিকে চাচাতো বোনকে নিয়ে তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়েছিলেন ভর্তি করাতে। তখন অফিস সহকারী রেজাউল করিম তাকে হয়রানি করেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কলেজছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে গ্রেপ্তার রেজাউল করিম। ছবি: নিউজবাংলা
মেয়েটি জানান, তাকে দেখে রেজাউল বলেন, তিনি বেশ লম্বা এবং এ কারণে তার পুলিশে চাকরি হয়ে যাবে। এই কথা বলে তাকে ওজন মাপার জন্য পাশের কক্ষে নিয়ে গিয়ে হয়রানি করা হয়।
মেয়েটির পরিবার কলেজের অধ্যক্ষ ইসমাইল হোসেনকে বিষয়টি জানায়। পরদিন কলেজের এক কক্ষে অধ্যক্ষ বিচার বসান। সেখানে রেজাউলকে চড়থাপ্পড় মেরে পা ধরে মাফ চাওয়ানো হয়। জরিমানা করা হয় দেড় লাখ টাকা।
মেয়েটি জানান, সালিশে উপস্থিত ছিলেন কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রবীর কুমার সাহা, শেরকোল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজাউল ইসলাম, স্কুল কমিটির সভাপতি ভেটু চৌধুরী, শিক্ষক আমিনুল ইসলাম, হাসান আলী ও চিকিৎসক মো. সামাদ।
অধ্যক্ষ ইসমাইল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যৌন হয়রানির সত্যতা পেয়ে ম্যানেজিং কমিটির লোকজন ও সহকারী অধ্যাপক প্রবীর কুমার সাহাকে নিয়ে সমঝোতা করে দিয়েছেন।’
ফৌজদারি অপরাধ এভাবে মীমাংসা করতে পারেন কি না এমন প্রশ্নে অধ্যক্ষ বলেন, ‘বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে মেয়েটার নানা রকম ঝামেলা হতো। তাই মীমাংসার উদ্যোগ নিয়েছি।’
সহকারী অধ্যাপক প্রবীর কুমার সাহা বলেছেন, তিনি সেদিন কলেজে থাকলেও মীমাংসায় ছিলেন না। যদিও এই চেষ্টায় তিনি কোনো সমস্যা দেখেন না। বলেন, ‘মীমাংসা হলেও ক্ষতি কী?’
হাতিয়ান্দহ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহাবুব-উল-আলম জানান, কলেজের অধ্যক্ষ বা কেউ তাকে বিষয়টি জানায়নি। তবে তিনি লোকমুখে শুনেছেন। যতটুকু শুনেছেন তাতে এ ধরনের বিচার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
পুলিশ যা করেছে
নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২৮ ডিসেম্বর ওই কলেজছাত্রী তার চাচাতো বোনকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করাতে ওই স্কুলে যান। ভর্তির কাগজপত্র জমা দেবার পর কৌশলে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে তাকে যৌন নিপীড়ন করেন। মেয়েটি কোনোমতে নিজেকে ছাড়িয়ে বোনকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন।’
তিনি বলেন, ঘটনাটি খুব গোপনে মীমাংসা করা হয়েছে। তবে জানার পরই বুধবার রাতে রেজাউলকে আটক করা হয়।
এরপর ওই রাতেই মেয়েটি থানায় যৌন নিপীড়নের মামলা করলে রেজাউলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এসপি বলেন, ‘মীমাংসাকারীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।’
ছাত্রীর মা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। মিলমিশ না কইরে কোনো উপায় আছে? আর মিয়া ছাওয়ালের নামে কোনো রকম দুর্নাম রইট্যা গেলে মিয়াকে বেইচে পারব্যো না।
‘তবে পড়তে গিয়েও যদি মিয়্যা ছাওয়াল নিরাপত্তা না পায় তাহলে তো ছাওয়ালকে স্কুল কলেজে দেয়া বন্ধ করে দিতে হবি।’
অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে কমিটি
বৃহস্পতিবার ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রমজান আলী। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া মীমাংসাকারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।