রাজধানীর মিরপুরের টেকনিক্যাল মোড় থেকে গত ৫ জানুয়ারি রাতের প্রথম প্রহরে অভিনেত্রী আশা চৌধুরীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, সেদিন রাত ২টার দিকে আশা ট্রাকচাপায় নিহত হন বলে তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন। আশার বাবা এ ঘটনায় মামলা করেছেন দারুসসালাম থানায়। মামলায় সন্দেহভাজন আসামি করা হয়েছে আশাকে মোটরবাইকে বহনকারী শামীম আহমেদকে। এছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় কয়েক জনকে আসামি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন আশা। অভিনয় ও লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি বায়িং হাউসে চাকরি করতেন।
আশা রূপনগর আবাসিক এলাকার ২১ নং রোডের ৩৭ নং বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। শামীমের বাসা কল্যাণপুরে।
দারুসসালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, মামলায় শামীম আহমদেকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই আড়াই ঘণ্টা তারা কোথায় ছিলেন, কেন ছিলেন সেসবের বর্ণনা দিয়েছেন শামীম। বলেছেন, খাবারের জন্য মিরপুর থেকে শ্যামলী গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে টেকনিক্যাল মোড়ে দুর্ঘটনায় পড়েন তারা।
আশার বাবা আবু কালাম বলছেন, শামীম তাদের পূর্বপরিচিত। ৪ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকেও মেয়ের সঙ্গে তাদের কথা হয়। আধা ঘণ্টার মধ্যেই বাসায় ফেরার কথা ছিল আশার। রাত ২টার দিকে দুর্ঘটনা ঘটলে মাঝের আড়াই ঘণ্টা তারা কোথায় ছিলেন, কী করেন-তা জানতে চান তারা। শামীম যে খাবারের কথা বলছেন, তা নিয়েও সন্দিহান আশার বাবা। তার ধারণা, ‘অন্য কিছুও’ খাওয়ানো হতে পারে আশাকে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, ফরেনসিক রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে না। রিপোর্ট আসতে এক মাস লাগতে পারে।
আশার বাবা আবু কালাম বলেন, ‘আমার মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে রাত ১১টার সময়। সর্বোচ্চ সাড়ে ১১টার মধ্যে বাসায় আসার কথা আশার। তাহলে এই আড়াই ঘণ্টা সে আমার মেয়েকে নিয়ে কী করল? শামীম যে খাবার খেতে যাওয়ার কথা বলতেছে, এত রাতে খাবারের দোকান কই খোলা থাকে?
‘আমার কথা হচ্ছে, এত রাতে কিসের খাওয়া-দাওয়া? শামীম আমাদের পরিচিত ছিল। শামীম আমার স্ত্রীকে আন্টি বলে ডাকত। শামীমের কাছে আমার একটাই কথা-সত্য করে বলো, এত রাতে কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে, সত্য করে বল। আর আমার মেয়েকে কই থেকে কী খাওয়াইছে-এটাও বলতে হবে।’
আবু কালাম বলেন, ‘আশা আমার চার মেয়ের মধ্যে বড়। আমার মেয়ের স্বপ্ন ছিল ব্যারিস্টার হতে লন্ডন গিয়ে পড়ালেখা করবে। এরপর টাকা উপার্জন করে বাড়ি-গাড়ি করে চার বোনসহ আমাদের নিয়ে সুখে-শান্তিতে কাটাবে।’
দারুসসালাম থানার ওসি তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে যতটুকু জানতে পেরেছি, এটা একটি সড়ক দুর্ঘটনা। শামীম আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছি, প্রথমত ওই রাতে নাকি অনেক জ্যাম ছিল।
‘বনানী থেকে তারা রওনা হয়ে কালশী ফ্লাইওভার হয়ে মিরপুর ১২ নম্বর যান। সেখান থেকে মিরপুর ৬ নম্বর হয়ে শিয়ালবাড়ি মোড়ে আসেন। সেখানে তারা চা খান। পরে মিরপুর ১ হয়ে শ্যামলী গিয়েছিলেন খাবারের দোকানের খোঁজে।’
শামীমের বরাত দিয়ে ওসি বলেন, ‘আশা চিকেন কাবাব বা ফ্রাই জাতীয় খাবার খেতে চেয়েছিলেন। তাই এত রাতে দোকান খোলা না পেয়ে চিকেনের খোঁজে শ্যামলী অবধি গিয়েছিলেন। এ কারণে তাদের এত দেরি হয়েছিল।
‘শ্যামলী থেকে টেকনিক্যালে হয়ে বাসায় যাওয়ার সময় টেকনিক্যাল মোড়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। আমরা যে সিসিটিভি ফুটেজটা পেয়েছি, সেটা স্পষ্ট না। তাই ট্রাক ও ট্রাকচালক খুঁজতে আমাদের সময় লাগছে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) সোহান আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত ৫ তারিখ রাতে টেকনিক্যাল মোড়ে আনুমানিক দেড়টা থেকে দুইটার মাঝে একটা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। লাশের কাছে গিয়ে দেখি একটা ছেলে আছে সঙ্গে।
‘পরবর্তীতে আশার পরিবার আসে এবং আমি তাদের সব বুঝিয়ে দেই। তদন্ত করতে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে জানতে পারি মোটরবাইকের সামনে একটা কাভার্ড ভ্যান ছিল। পেছন থেকে বড় একটি ট্রাক আশাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটা একটি সড়ক দুর্ঘটনা।’
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘শামীম আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছি, তাদের ৮ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই কারণে তারা মাঝেমধ্যেই ঘোরাফেরা করত। শুনেছি তাদের মধ্যে ভাইবোনের সম্পর্ক ছিল।
‘আশার মাঝেমধ্যে প্রয়োজন হলে শামীম তাকে লিফট দেয়। মেয়েটির বাসা রূপনগর, ছেলটির বাসা কল্যাণপুর।’
পরিবারের ভাষ্যমতে, আশার সাড়ে ১১টার মধ্যে বাসায় পৌঁছানোর কথা ছিল। তিনি দুর্ঘটনায় পড়েন রাত ২টার দিকে।
তাহলে তারা এই আড়াই ঘণ্টা কোথায় ছিলেন-আশার বাবার এই প্রশ্ন করা হয় তদন্ত কর্মকর্তা সোহান আহমেদকে।
জবাবে নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই আড়াই ঘণ্টা তারা বাইকে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা, খাওয়া-দাওয়া করেছে বলে জানতে পেরেছি। মেয়েটা খাবার খাবে এবং বাসার জন্য খাবার নিয়ে যাবে বলে তারা ঘুরে ঘুরে খাবারের দোকান খুঁজেছে।
‘যে ট্রাক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দুর্ঘটনাটি ঘটিয়েছে, আমরা সেই ট্রাকটি আটক করার চেষ্টা চালাচ্ছি। ঢাকায় কোথাও ট্রাকটি খুঁজে পাচ্ছি না। কালকে আমরা ঢাকার বাইরে যাচ্ছি ট্রাকটির সন্ধানে।’
তদন্ত কর্মকর্তা জানান, তাদের পাশাপাশি সিআইডি ও ডিবি বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। সিসিটিভি ফুটেজে গাড়ির নম্বর পাওয়া যায়নি। ট্রাকের বাম পাশে গ্লাসের সাইডে ওপরে নম্বর প্লেট হওয়ার কারণে সিসিটিভি ফুটেজ জুম করলে ফেটে যাচ্ছে। তাই নম্বর পেতে ঝামেলা হচ্ছে।
‘পরিবারের ধারণা তাদের মেয়েকে কিছু খাইয়েছে। তবে ফরেনসিক রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না। রিপোর্ট আসতে এক মাস লাগতে পারে’, বলেন সোহান আহমেদ।
আরও পড়ুন: ‘সড়ক দুর্ঘটনায়’ অভিনেত্রী আশা নিহত