দিনটি ছিল শুক্রবার। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর ৬টায় ফুলবাড়ির অনন্তপুর সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরছিল কিশোরী ফেলানী। পথে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিবিদ্ধ হয়ে তার নিথর দেহ কাঁটাতারের ওপর ঝুলে থাকে সাড়ে ৪ ঘণ্টা।
বিএসএফের গুলিতে ফেলানী হত্যার ১০ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১১ সালের এই দিনে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে কিশোরী ফেলানী বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়।
এ ঘটনায় বিশ্বব্যাপী তোলপাড় শুরু হলে ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট ভারতের কোচবিহার জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্টে হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। বিএসএফের কোর্টে সাক্ষ্য দেন ফেলানীর বাবা নূর ইসলাম ও মামা হানিফ।
একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর আসামি বিএসএফ জোয়ান অমিয় ঘোষকে খালাস দেয় বিশেষ কোর্ট। রায় প্রত্যাখ্যান করে পুনর্বিচারের দাবি জানায় ফেলানীর পরিবার। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পুনর্বিচার শুরু হলে ১৭ নভেম্বর আবারও আদালতে সাক্ষ্য দেন ফেলানীর বাবা।
২০১৫ সালের ২ জুলাই আদালতে ফের আত্মস্বীকৃত আসামি অমিয় ঘোষ পুনরায় খালাস পান। রায়ের পর একই বছর ১৪ জুলাই ভারতের মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) ফেলানীর বাবার পক্ষে দেশটির সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট পিটিশন করে।
ওই বছরের ৬ অক্টোবর রিট শুনানি শুরু হয়। এরপর ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দফায় দফায় শুনানির দিন ধার্য হয়। কিন্তু হয়নি শুনানি। গত বছরের ১৮ মার্চ সর্বশেষ শুনানির তারিখ নির্ধারণ হলেও করোনার কারণে তা আর হয়নি।
বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ৯টির মধ্যে ৭টি উপজেলায় রয়েছে ভারতীয় সীমান্ত। এসব সীমান্তে স্বাধীনতার ৪৯ বছরে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে ৮১ জন। আহত হয়েছেন অনেক মানুষ। ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে হরহামেশাই।
সীমান্ত এলাকায় কৃষিকাজ, চোরাচালান বা মানব পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে দরিদ্র ও নিরীহ নারী-পুরুষ এ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। এদেরই এক জন ফেলানী।
জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের কলোনীটারী গ্রামের নুর ইসলাম অভাবের কারণে বেশ কয়েক বছর আগে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পাড়ি জমান ভারতে। পরিবার নিয়ে থাকতেন ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার বঙ্গাইগাঁও গ্রামে। দালালের মাধ্যমে কাঁটাতার পেরিয়ে নিজ এলাকায় আসতেন তারা।
ফেলানীর বাবা নুর ইসলাম জানান, ১৪ বছরের কিশোরী ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল বাংলাদেশে। মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য ২০১১ সালের ৬ জানুয়ারি ফেলানীকে নিয়ে রওনা হন দেশের উদ্দেশ্যে। ৭ জানুয়ারি ভোরে ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার চৌধুরীর হাট এবং কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ির অনন্তপুর সীমান্তে কাঁটাতারের ওপর মই বেয়ে ওঠার সময় বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে নিহত হয় ফেলানী।
কাঁটাতারে ঝুলছে ফেলানীর মরদেহ।
তিনি জানান, ফেলানী হত্যার বিচার চেয়ে অনেক ঘুরেছেন। মানবাধিকার সংস্থাসহ অনেকের কাছে গেছেন; বিচার পাননি।
২০২০ সালের ১৮ মার্চ করোনার সংক্রমণ শুরুর আগে শুনানির তারিখ থাকলেও তা হয়নি। এখন আর কোনো খোঁজখবর জানেন না।
নুরুল বলেন, বিচারের অন্তহীন অপেক্ষায় আছেন। তার জীবদ্দশায় মেয়ে হত্যার ন্যায়বিচার দেখে যেতে চান।
ফেলানীর মা জাহানারা বেগম বলেন, তার মেয়ে ফেলানীর মৃত্যুর ১০ বছর হয়ে গেলে। কিন্তু হত্যাকারীর বিচার পাননি।
তিনি জানান, সকালে উঠে ফেলানীর কবরটি পরিষ্কার করেন। যে মায়ের কোল খালি হয়েছে তিনিই জানেন সন্তান হারানোর কী যন্ত্রণা।
মেয়ের বাঁধানো কবরের দেয়াল পরিষ্কার করছেন ফেলানীর মা জাহানারা বেগম। ছবি: নিউজবাংলা
ফেলানীর মায়ের আক্ষেপ, আজও শোনেন সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মানুষ মরে। ফেলানী হত্যার বিচার হলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হতো। তারা আর সাহস পেত না।
‘আমার ফেলানী হত্যাকারীর শাস্তি চাই। আর সীমান্তে যেন একটা পাখিও গুলিতে না মারা যায় এটাই আমার দাবি ভারত-বাংলাদেশের সরকারের কাছে।’রামখানা সীমান্তের বাসিন্দা খালেক জানান, ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার হলে বিশ্বে একটা উদাহরণ সৃষ্টি হতো যে, অন্যায় করেও কেউ পার পায় না।একই এলাকার বাসিন্দা মজিবর রহমান বলেন, অভাবী এলাকা হওয়ায় এখানে কাজের সুযোগ কম। তাই সীমান্ত এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা নেই। ফলে কাজ না থাকায় মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত দিয়ে মাদক, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এতে সীমান্তে বিএসএফের হাতে জীবন দিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, সীমান্ত এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলে হত্যা অনেকটাই কমে আসবে।কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর এসএম আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ফেলানী হত্যার রিটের শুনানির তারিখ কয়েক দফা পিছিয়েছে। করোনা মহামারিতে ভার্চুয়ালি কোর্ট চলছে।
‘পরিস্থিতি ভালো হলে রিটের শুনানি হবে। আশা করছি ফেলানীর পরিবার ন্যায়বিচার পাবে।’