বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এক যুগে কৌশলী ভারসাম্যের কূটনীতি

  •    
  • ৭ জানুয়ারি, ২০২১ ০৮:২৪

গত এক যুগে প্রতিবেশী ও বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যের কূটনীতি সফলভাবে অনুসরণ করেছে বাংলাদেশ। এটি অর্থনৈতিক বিকাশ ও বিনিয়োগে বড় ভূমিকা রেখেছে।

গত ১২ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার তার চিরায়ত দ্বিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষিক কূটনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বৈশ্বিক জলবায়ু কূটনীতি, অর্থনৈতিক ও সামরিক কূটনীতিতে দৃঢ় ও কৌশলী অবস্থান। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এটাকে বর্তমান সরকার বা রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সাফল্য হিসেবে দেখছেন।

গত এক যুগে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মাঠে ভারসাম্যের কৌশলী নীতি নিয়ে এগিয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ককে কূটনীতির সঙ্গে এমনভাবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে যা থেকে দেশ লাভবান হয়েছে।

এই ১২ বছরের শুরুর দুই বছর বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশকে লড়তে হয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে। কূটনৈতিক সাফল্যের কারণে মন্দার প্রভাব এড়াতে সক্ষম হয় দেশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা ছিল খুবই কৌশলী ও পরিণত কূটনীতি।’

তিনি বলেন, গত এক যুগে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়া, সৌদি আরব, ইরান বা তুরস্ক—সবার সঙ্গেই ভারসাম্য রক্ষায় সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী ও বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যের কূটনীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও বিনিয়োগে বড় ভূমিকা রেখেছে।

অধ্যাপক দেলোয়ার মনে করেন, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে গত ১২ বছরে। যুগের পর যুগ ঝুলে থাকা ছিটমহল বিনিময় হয়েছে, ৪ হাজার কিলোমিটার সীমান্তের পুরোটাই চিহ্নিত হয়েছে, বেড়েছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক গভীর হয়েছে চীনের সঙ্গে।

অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই চীন-আওয়ামী লীগ সম্পর্ক নিয়ে সন্দিহান ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় বসে সেসব না ভেবে নতুন সম্পর্ক তৈরি করেন চীনের সঙ্গে। ২০১০ ও ২০১৪ সালে তিনি দুই দফা চীন সফরে যান। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ বাংলাদেশ সফরে আসেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং। এই সফরে সরকারি-বেসরকারি খাতে ৩৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি হয়।

তবে সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমির চীনের সঙ্গে এই সম্পর্ককে এতটা উঁচু স্তরে দেখতে রাজি নন। তিনি এই সম্পর্ককে কেবলই বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখতে চান।

নিউজবাংলাকে মোহাম্মদ জমির বলেন, ‘চীন বাংলাদেশের সঙ্গে যে সম্পর্কটা তৈরি করছে, সেটা আসলে তাদের বাণিজ্যের স্বার্থেই। তারা আমাদের কাছে বেশি পণ্য বিক্রি করছে। কিন্তু কিনছে কম। সে তুলনায় জাপানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা বেটার। তারা আমাদের কাছ থেকে প্রচুর পণ্য কেনে এবং সাহায্য দেয়।’

অধ্যাপক ড. দেলোয়ার মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি ড. ইউনূস ইস্যুতে কিছুটা শীতল হলেও তা কাটাতে সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট (টিকফা) করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সামরিক সহযোগিতা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ক্ষমতায় এসেই একাত্তরের মিত্র রাশিয়ার সঙ্গে ঝিমিয়ে পড়া সম্পর্ককে জাগ্রত করেন শেখ হাসিনা। মস্কো সফরে যান। এরপর সামরিক সহযোগিতা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, জ্বালানি সহায়তাসহ নানা ইস্যুতে চুক্তি ও সমঝোতা হয়।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থানকেও কূটনীতিতে বাংলাদেশের বিজয় হিসেবে দেখেন বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক দেলোয়ার মনে করেন, এ ইস্যুতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে মানবিক কূটনীতিতে বাজিমাত করেছে। ছোট দেশ হলেও বাংলাদেশ মিয়ানমারের এই নির্যাতিত মানুষকে আশ্রয় দিয়ে যে মানবিকতার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তা অতুলনীয়।

চীন-ভারত বা চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ‘ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি’ অনুসরণ করতে পারছে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর।

তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের পর এটা কঠিন হয়ে যাবে। তখন আমরা উন্নয়নশীল দেশে উঠে যাব। এখন যে সুবিধা পাই তখন তা পাব না। এ জন্য আমাদের কূটনৈতিক টিমকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।’

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার ভূমিকা সম্পর্ক অধ্যাপক ড. দেলোয়ার বলেন, ‘ইয়েমেনের হুতিবিরোধী সন্ত্রাসবিরোধী জোটে যোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ। আবার ইরান, তুরস্কের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক গভীর হচ্ছে। মোট কথা বাংলাদেশ তার স্বার্থে সবকিছুতে যুক্ত হচ্ছে বা নিজেকে বিরত রাখছে।’

২০১৫ সালের ১ আগস্ট ভারত ও বাংলাদেশের স্থায়ী সীমানা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ৬৮ বছরের এক অমীমাংসিত অধ্যায়ের। এর ফলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ১৬২টি ছিটমহলের অর্ধ লক্ষাধিক ‘দেশহীন’ মানুষের অনিশ্চিত জীবনের অবসান হয়।

বাংলাদেশের সে সময়ের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, প্রক্রিয়াগুলো ঘটেছিল খুবই পরিকল্পিতভাবে। ছিটমহল বিনিময়ের পর ছিটের মানুষের নাগরিকত্ব, ছিটের উন্নয়ন বাজেট মাথায় রেখে কাজ করতে হয়েছে। বাজেট খরচের জন্য জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব দেয়া হয়। দেশের মানচিত্রে যুক্ত হওয়া ভূমির নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মৌলিক সেবা দেয়ার পরিকল্পনাও মাথায় রেখে কাজ করতে হয়।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির নিউজবাংলাকে বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের পক্ষ থেকে যে বিষয় বড় করে দেখা হয়, তা হলো সে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, বিশেষ করে পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেই সে সমস্যার সমাধান করে। ফলে ভারত চাপে পড়ে ছিটমহল বিনিময় ও সীমানা চিহ্নিতকরণসহ বাংলাদেশের চাহিদা মেটাতে।

মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রজয়

আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মীমাংসার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে সমুদ্র সংক্রান্ত বিরোধের সম্ভাবনা চিরতরে দূর করেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের সমুদ্রসীমার আয়তন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় স্থলভাগের সমান। ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটারের এই ব-দ্বীপের সমুদ্রসীমার আয়তন এখন ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দশকের পর দশক আলোচনায় ফল না পেয়েই আন্তর্জাতিক আদালতে যায় বাংলাদেশ। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা চূড়ান্ত না থাকায় প্রায়ই দুই দেশের সঙ্গে ঝামেলা হচ্ছিল বাংলাদেশের। আদালত বিরোধপূর্ণ আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশকে এবং প্রায় ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতকে দেয়।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সমুদ্রজয় বলতে গেলে এটাকে অন্য কারো জন্য পরাজয়ও বলতে হয়। আমি মনে করি এতে কেউ জেতেনি বা কেউ হারেওনি। আমি মনে করি বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে আদালতে যাওয়ার ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

‘এটা ছিল ম্যাচিউরড কূটনৈতিক পদক্ষেপ। এতে দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত যেমন এড়ানো গেছে, তেমনি সবার সঙ্গে শান্তি প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।’

অধ্যাপক দেলোয়ার বলেন, তিস্তা চুক্তি না হওয়া ও সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে না পারা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক। এই ব্যর্থতার দায়ভার বাংলাদেশের নয়, ভারতের। তাদেরই এসব বিষয়ে সমাধান খুঁজতে হবে।

এ বিভাগের আরো খবর