দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর রাজধানীর থানায় অভিযোগ কমেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের হিসাবে এই সময়ে থানাগুলোতে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় মাসে গড়ে ১০টি করে মামলা কম হয়েছে। যদিও করোনাকালে আয় কমে যাওয়া আর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে খিটমিটে হয়ে যাওয়ার কথা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বারবার উঠে আসছিল।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২২ ধরনের অপরাধের মধ্যে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কমেছে ১৫ ধরনের অপরাধ, বেড়েছে পাঁচটি ও একই অবস্থায় রয়েছে দুটি।
মার্চে দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর এপ্রিল ও মে মাসে সব ধরনের অপরাধ উল্লেখজনক হারে কমে আসে। তবে জুনে আবার বাড়তে শুরু করে।
কমেছে ডাকাতি, ধর্ষণ, অন্যান্য নারী নির্যাতন, অপহরণ, পুলিশের ওপর হামলা, সিঁধেল চুরি, গাড়ি চুরি, তার চুরি, গরু চুরি, অন্যান্য চুরি, অস্ত্র, বিস্ফোরক, মাদক, চোরাচালান ও অন্যান্য খাতের অপরাধ।
বেড়েছে দস্যুতা, খুন, দাঙ্গা, অ্যাসিড নিক্ষেপ ও শিশু নির্যাতন। অপরিবর্তিত রয়েছে দ্রুত বিচার ও নারী আহতের ঘটনা।
করোনা মহামারির শুরুতে সাধারণ ছুটির কারণে সবাইকে ঘরে থাকতে হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মানাতে পুলিশেরও ছিল বাড়তি তৎপরতা। যে কারণে অপরাধ কম হয়েছে বলে মনে করেন মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০২০ সালে কয়েক মাস অপরাধ কম ছিল। করোনা সংক্রমণের শুরুতে মানুষজন ঘরে থাকায়, বাইরের অপরাধ কমেছিল। কিন্তু আবার সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু হওয়ার পর সেটা বেড়েছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে সবগুলো থানায় মামলা হয়েছিল ২৭ হাজার ৯৩৪টি। আর ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মামলা হয়েছে ২০ হাজার ২৬৬টি। ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার ৬৯৭টি।
মামলার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এপ্রিল, মে, জুন ও আগস্ট মাসে মামলার সংখ্যা ছিল কম। বাকি মাসগুলোতে গড়ে দুই হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এপ্রিলে মামলার সংখ্যা ছিল সবচেয়ে কম, মাত্র ৩৫১টি। মে মাসে মামলা ছিল ৫১৮ ও জুনে ছিল এক হাজার ১৭৭টি। জুলাইয়ে বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৪০৯। তবে আগস্টে আবার কমে হয় এক হাজার ৮৬১টি। এরপর আর মামলার সংখ্যা দুই হাজারের নিচে নামেনি।
লকডাউনের পর অপরাধের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী বলে জানিয়েছেন ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মাহবুব আলম।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লকডাউন পরিস্থিতির সময়টায় অপরাধ কম ছিল। পরবর্তী পরিস্থিতি ঊর্ধ্বমুখী। চুরি, প্রতারণা বেশি হচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে বাড়ছে বলে দেখছি আমরা।’
কেন বাড়ছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আয় কমেছে। সব মিলিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক একটা অস্থিরতা আছে।’
২০২১ সালে সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধ, প্রতারণা, সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান ডিএমপির এ কর্মকর্তা।
দেশে সাধারণ ছুটি চলাকালে বাইরে অপরাধ কম হলেও ঘরের ভেতর বেড়েছিল বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাধারণ ছুটি শুরুর পর বেশ কিছু অপরাধ কমেছিল। যেমন অর্গানাইজড ক্রাইম কম হয়েছে। তবে ইনডোর ক্রাইম তখন বেড়ে যায়। শিশু ও নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে সাইবার অপরাধ।’
জুলাই থেকে মাদক ও অনলাইনে কেনাকাটায় প্রতারণা সংক্রান্ত অপরাধ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, ‘জুলাই থেকে কিছু কিছু ক্রাইম আবার বাড়তে শুরু করে। যেমন ড্রাগ ডিলিং ও অনলাইন জালিয়াতি। তখন মানুষ ঘরে থেকে অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হতে শুরু করে। প্রতারকরাও এই সময়টা বেছে নেয়। এরপর ডাকাতি বা ভায়োলেন্ট ক্রাইমগুলো বেড়ে যায়।’
করোনার প্রভাবে কাজ হারানো ও দীর্ঘদিন একই জায়গায় থাকতে বাধ্য হওয়ায় মানুষের মাঝে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন এসেছে। যে কারণে অপরাধও ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।