যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে বিমানে আসা সিলেটের ৪২ যাত্রীকে হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে নিতে চাইলে তারা আপত্তি জানিয়ে হট্টগোল করেন। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত কার্যকরে প্রশাসন অনঢ় থেকে তাদের হোটেলে পাঠাতে সক্ষম হয়।
লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ৪৮ জন যাত্রী নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট সোমবার দুপুর ১২টার দিকে সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর সিলেটে নেমে যাওয়া ৪২ যাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। পরে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্য দিয়ে বাসে তোলার সময় তারা হট্টগোল শুরু করেন।
কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গালাগালি করেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রতিও ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে। প্রায় সবাই হোটেলে কোয়ারেন্টিনে যেতে অস্বীকৃতি জানান।
কিন্তু আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তারা ছিলেন তাদের সিদ্ধান্তে অটল। তবে তারা সহিষ্ণু আচরণ করেন। লন্ডনফেরতদের বুঝিয়ে সিলেটের দরগাহ গেটে দুইটি হোটেলে নিয়ে যান।
যুক্তরাজ্য থেকে আসা আসলাম উদ্দিন নামের এক জন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন পরে দেশে এসেছি আত্মীয়স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। ১৪ দিন হোটেলেই বন্দি থাকতে হলে দেশে আসলাম কেন?’
তিনি বলেন, ‘আমি আমার পরিবারে সাথে থাকতে চাই। এতে পরিবারের সদস্যদের আপত্তি নেই। সরকার বা প্রশাসন এতে আপত্তি করবে কেন?’
হোটেলের ভাড়া পরিশোধে আপত্তি
যুক্তরাজ্য থেকে আসা ব্যক্তিদের জন্য আগে থেকেই নগরের দরগা গেট এলাকার হোটেল স্টার স্পেসিফিক ও হোটেল হলি গেটকে বাছাই করে জেলা প্রশাসন। প্রথমে সব যাত্রী চার তারকা হোটেল স্টার স্পেসিফিকে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিকেল তিনটার দিকে তাদের এই হোটেলে আনা হয়। তবে হোটেলে এসে এখানকার থাকা-খাওয়ার খরচ শুনে তারা আপত্তি তোলেন।
এ সময় কয়েক জন পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে চান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের বুঝিয়ে আবার হোটেলের ভেতরে নিয়ে যান।
তবে নিজদের খরচ বহন করা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত হোটেলের লবিতে বসে থাকেন প্রায় সবাই। কেউ কেউ চিৎকার করে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
সুয়ের আহমদ নামের এক জন বলেন, ‘এখানকার হোটেল কক্ষে ন্যূনতম ভাড়া প্রতিদিন ৬ হাজার টাকা। এরপর আছে খাওয়া-দাওয়াসহ অন্যান্য খরচ। এতে ১৪ দিনে লাখ টাকার ওপরে চলে যাবে। দেশে আমি সীমিত টাকা নিয়ে এসেছি। এখন হোটেলেই এত টাকা চলে গেলে পরে বাড়িতে গিয়ে কীভাবে থাকব?’
অব্যবস্থাপনার অভিযোগ
প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ করেছেন অনেকে। কয়েক জন বলেন, ‘দীর্ঘ বিমানযাত্রায় আমরা দেশে এসেছি। কিন্তু স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে আমাদের বিমানবন্দরেই দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা আকটে রাখা হয়। এরপর হোটেলে যাওয়ার জন্য বাস রাখা হয়েছে, সেখানে আমাদের লাগেজ রাখার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। বড় বড় লাগেজ নিজেদের সিটে রেখেই হোটেলে আসতে হয়েছে। হোটেলে এসেও আমরা নানা বিড়ম্বনার শিকার হয়েছি।’
আসলাম উদ্দিন ও সুয়েব আহমদ বলেন, ‘সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করলে আমরা আপত্তি করতাম না। দেশে আসলাম কয়েক দিন আরাম করার জন্য। কিন্তু এখানে এসে উল্টো দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’
কর্তা ব্যক্তিরা যা বলছেন
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) বি এম আশরাফ উল্লাহ তাহের বলেন, ‘প্রবাসীরা দেশে এসেই হোটেলে থাকা নিয়ে আপত্তি জানান। তাদের বুঝয়ে নিয়ে আসতে অনেকটা দেরি হয়েছে। আবার হোটেলে এসেও তারা হট্টগোল করেন। পুলিশের সাথেও খারাপ ব্যবহার করেন কেউ কেউ। নিজ নিজ কক্ষে না গিয়ে লবিতে বসে থাকেন। তবে পুলিশ পুরোটা সময় নমনীয়ভাবে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছে।’
তিনি বলেন, হোটেলের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকাকালে কেউ তাদের সঙ্গে স্বজনরা দেখা করতে পারবেন না। সে জন্য হোটেলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
সিলেট এমএজি ওসমানী বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমদ বলেন, বিমানবন্দরে নামার পর সব যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার নির্দেশনা রয়েছে। এতে কিছুটা দেরি হওয়াই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, দেশে আসা সবার কোয়ারেন্টিন বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম জানান, লন্ডন থেকে আসা যাত্রীদের জন্য হোটেল স্টার স্পেসিফিকের পুরো চতুর্থ তলা ও হোটেল হলি গেটের পুরোটা বরাদ্দ নেয়া হয়েছে।
ওসমানী বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, সপ্তাহের প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে সিলেট ওসমানী আন্তর্জতিক বিমানবন্দরে বিমানের সরাসরি ফ্লাইট আসে।
গত ২৪ ডিসেম্বর ২০২ জন, ২৮ ডিসেম্বর ২০২ জন এবং ৩১ ডিসেম্বর ২৩৭ যাত্রী নিয়ে বিমানের তিনটি ফ্লাইট ওসমানী বিমানবন্দরে আসে। এই তিন দিন আসা যাত্রীদের মধ্যে যথাক্রমে ১৬৫, ১৪৪ ও ২০২ জন ছিলেন সিলেটের। বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে তাদের প্রত্যককেই হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দিয়ে চলে যেতে দেয়া হয়েছিল।
যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের (স্ট্রেইন) সংক্রমণের কারণে দেশটির সঙ্গে অনেক দেশ বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে আসা যাত্রীদের নিজ খরচে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। ২৮ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে এই নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা কার্যকর হয় ১ জানুয়ারি। এরপর সোমবারই প্রথম ফ্লাইট এলো।