পোস্টাল মানি অর্ডার জাল করে নানা ধরনের প্রতারণায় জড়িত একটি চক্রের ছয় জনকে রাজধানীর আগারগাঁও থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে র্যাব।
রোববার কুর্মিটোলায় র্যাব সদরদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানিয়ে বলা হয়, মানি অর্ডার জাল করে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। গোপন তথ্যে রোববার ভোরে আগারগাঁওয়ের তালতলা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় চক্রটির প্রধান ফজুলল হক আশরাফ ও তার স্ত্রী আছমা আক্তার শিমুকে।
পরে তাদের তথ্যে বিকেলে গ্রেপ্তার করা হয় জিপিওর কর্মচারী আমজাদ আলী, মোস্তাফিজুর রহমান ও ডলি রাণী সাহা এবং তাদের সহযোগী লিংকন সাহাকে। এ সময় দেড় লাখ টাকা, জিপিওর বিপুল সংখ্যক সিল ও মানি অর্ডার ফরম জব্দ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ফজলুল হক ২০১৮ সালে প্রথমে পোস্টাল সার্ভিসের কতিপয় কর্মচারীর সহায়তায় মানি অর্ডারের টাকার পরিমাণ পরিবর্তন করে জালিয়াতি শুরু করেন। তিনি নিজেকে পথশিশু ফাউন্ডেশন, সানোয়ার ফাউন্ডেশন ও অ্যারোলাইট বায়োগ্যাস নামের সংগঠনের প্রধান দাবি করতেন।
আশিক বিল্লাহ বলেন, ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা জিপিওর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন, একটি প্রতারক চক্র পোস্টাল মানি অর্ডার জাল করে অভিনব উপায়ে টাকা উত্তোলন করছে। গত জুন-জুলাইয়ে কয়েক হাজার জাল মানি অর্ডারের সন্ধান পাওয়া যায়। শুধু ঢাকা জিপিওতে ৮ হাজার জাল মানি অর্ডার মেলে।
এ ছাড়া মিরপুর ও নিউমার্কেট পোস্ট অফিসেও বিপুল সংখ্যক জাল মানি অর্ডার পাওয়া যায়। সন্দেহভাজন প্রতারক হিসেবে জিপিও ফজলুল হক, আবুল বাশার ও শিমুর নামে মামলা করে। মামলার পর তারা আত্মগোপনে চলে যান। পরে এ বিষয়ে সহায়তা চেয়ে র্যাবের কাছে অভিযোগ করে জিপিও কর্তৃপক্ষ।
দেড় লাখ টাকা, জিপিওর বিপুল সংখ্যক সিল ও মানি অর্ডার ফরম জব্দ করে র্যাব-১
এরই ধারাবাহিকতায় রোববার (৩ জানুয়ারি) ভোরে তালতলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে চক্রের হোতা ফজুলল হক আশরাফ ও তার স্ত্রী আছমা আক্তার শিমুকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ বলেন, তিনি পথশিশুদের উন্নয়নে তাদের দিয়ে কাগজের ঠোংগা বানিয়ে বিক্রি করেন বলে জানান। স্বল্পমূল্যে এই কাগজের অব্যাহত সরবরাহের জন্য তিনি প্রথমত সব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ড চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন।
পরে হাইকোর্টে এক রিটের মাধ্যমে সব শিক্ষাবোর্ড থেকে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রতিটি খাতা ৬০ পয়াসায় ক্রয় করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। সে অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষকদের কাছ থেকে ৬০০ টাকার বিনিময়ে এক হাজার খাতা কেনা শুরু করেন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, তখন থেকেই তিনি জিপিওর মানি অর্ডার ফরম জাল করে ৬০০ টাকা মূল্যের মানি অর্ডার বিভিন্ন শিক্ষকদের নামে পাঠাতে শুরু করেন। আসল মানি অর্ডারের মতো সই ও সিল সম্বলিত নকল মানি অর্ডারগুলো কৌশলে জিপিওসহ বিভিন্ন পোস্ট অফিসে বিতরণ চ্যানেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
এ ছাড়া তিনি অ্যারোলাইট বায়োগ্যাস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ই-কমার্সের ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’র আদলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের কাছে কথিত জৈব সার পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি পোস্টাল সার্ভিসের ভিপি (Value Payable) ব্যবস্থা ব্যবহার করেন।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, পরবর্তীতে তিনি জৈব সারের ভুয়া বিক্রি দেখিয়ে তার অ্যারোলাইট বায়োগ্যাসের নামে একই পদ্ধতিতে জাল মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে শুরু করেন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি নিজেই মানি অর্ডারের প্রাপক।
প্রতারক ফজলুল অধিক পরিমাণের মানি অর্ডারগুলো সরকারি খামের মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট মাস্টার বরাবর পাঠাতেন। কিছুদিন আগে তিনি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানাধীন নাগরী পোস্ট অফিস থেকে প্রায় ৪৫০ চিঠি বিভিন্ন পোস্ট মাস্টার বরাবর পাঠান। খামের ভেতরে বিভিন্ন অংকের জাল মানি অর্ডার ছিল। প্রতিটা খামে প্রেরকের জায়গায় তিনি নাগরী পোস্ট মাস্টারের সিল ব্যবহার করেন।
নরসিংদী পোস্ট মাস্টারের কাছে খামটি পৌঁছালে তিনি সন্দেহ করেন। কারণ মানি অর্ডার ফরম সাধারণত খামে পাঠানো হয় না। তিনি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা তদন্ত করে জানতে পারেন, মানি অর্ডারগুলো জাল।
ফজলুল হক কৃষকদের সৌদি খেজুর গাছের চারা বিনামূল্যে বিতরণের প্রলোভনও দেখান বলে জানান র্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ।
তিনি বলেন, এর অংশ হিসেবে ফজলুল হক রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ১০০ টাকা বিকাশের মাধ্যমে নেন। একই সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠান পথশিশু কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পোস্টাল অর্ডারের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করেন।