‘জীবনের সব উপার্জন জমা করে বিনিয়োগ করেছিলাম। দুই বছর ধরে আমার চাকরি নাই। করোনার মধ্যে স্বামীর চাকরিও চলে যায়। এখন কোন আয় রোজগার নেই। নিদারুণ কষ্টে দিন যাপন করছি। টাকার জন্য সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারছি না। এক বছর ধরে সন্তানদের ভালো কোনো মাছ-মাংস খাওয়াতে পারি না।’
হাইকোর্টে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিজের জমানো টাকার ফেরত পাওয়ার দাবি করছিলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মেয়ে সামিয়া বিনতে মাহবুব।
আলোচিত ব্যাংকার পি কে হালদার কেলেঙ্কারিতে যারা পথে বসার দশা, তাদের একজন এই নারী।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়ে নাশিদ কামালও ভুক্তভোগীদের একজন। তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসে টাকা জমা রেখেছিলেন। এখন ফেরত পাচ্ছেন না।
জমানো টাকা ফেরত পেতে আদালতের কাছে আবেদন করেছেন জানিয়েছেন আমানতকারীরা। এ মামলায় পক্ষভুক্ত হতেও দাবি করেছেন তারা।
পরে আদালত তাদেরকে লিখিত বক্তব্য দাখিলের জন্য নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
রোববার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চে আজ শুনানি হয়।
আদালত এ বিষয়ে আদেশ দেবে মঙ্গলবার।
পি কে হালদারের বিরুদ্ধে পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে। নানা কৌশলে টাকা বের করে নিয়ে তিনি কানাডায় অবস্থান করছেন।
পিকে সম্প্রতি দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন গ্রেপ্তার না করার। এ জন্য আদালতে আবেদনও করেন। তবে হাইকোর্ট সে আবেদন গ্রহণ না করে দেশে ফেরামাত্র আটক করে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয়। পরে আর দেশে ফেরেননি।
গত ২ ডিসেম্বর পি কে হালদারের বিরুদ্ধে করা এজহারের ফটোকপি এবং গ্রেপ্তার পরোয়ানাসহ নথি চেয়েছিল হাইকোর্ট। তারই ধারাবাহিকতায় মামলাটি শুনানির জন্য আসে।
পিপলস লিজিংয়ে টাকা রেখে ভুক্তভোগী ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মেয়ে সামিয়া বিনতে মাহবুব বলেন, ‘আমি ক্যান্সারের রোগী। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে পিপলস লিজিং এ টাকা রেখেছিলাম, যেটা কি না বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত, নিবন্ধিত। এমনকি ঢাকা ও চট্টগ্রাম শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বাস নিয়ে আমরা সেখানে টাকা রেখেছি, আমি এবং আমার স্বামী মিলে সারা জীবনের অর্থ জমা করে এক কোটি টাকা রেখেছি।
‘এর মধ্যে আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। করোনার মধ্যে আমার স্বামীরও চাকরি নাই। এখন কোনো আয় নেই। চরম অর্থ সংকটে জীবনযাপন করছি। টাকার জন্য সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারছি না। সব মিলিয়ে আমরা মানসিক কষ্টে আছি।’
তিনি বলেন, ‘পিকে হালদার গং এভাবে সুটকেস ভর্তি করে টাকা নিয়ে যাবে, ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা নিয়ে যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না!’
পিপলস লিজিংয়ের এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা রয়েছে জানিয়ে সেখান থেকে ৭৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগকারীদের দিতে পারে বলেও মন্তব্য করেন সামিয়া। বলেন, ‘এই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। সংকটাপন্ন জীবন যাপন করছেন।’
আদালতে বক্তব্য রাখেন আরেক আমানতকারী প্রতিষ্ঠান খালেদ মনসুর ট্রাস্ট্রের হিসাব শাখার কর্মকর্তা তরিকুল ইসলামও। তার ট্রাস্ট্র ১০ কোটি টাকা জমা রেখেছিল প্রতিষ্ঠানটিতে। এই ট্রাস্ট দেশের বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে যুক্ত।
খালেদ মনসুর বলেন, ‘অসহায় গরিব মানুষদের এই টাকা হস্তগত করেছে তারা।’
এরপর মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক শওকোতুর রহমান বলেন, ‘সুষ্ঠভাবে বেঁচে থাকা, সন্তানের লেখাপড়া, বৃদ্ধ মায়ের চিকিৎসার জন্য এই টাকা রেখেছিলাম। টাকা রাখার পরে তারা নানাভাবে আমাকে হয়রানি করল, ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে আমাদের বিপদের মধ্যে ফেলে দিল।
‘আজকে নিজের সঞ্চিত অর্থ ফেরত পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। আমার আমানত ছিল ১৩ লাখ টাকা। এ টাকা আদৌ পাবে কি না সেই চিন্তা নিয়ে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছি।’
সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামালের মেয়ে নাশিদ কামালের অর্ধ কোটি টাকা রয়েছে পিপল লিজিংয়ে।
তিনি বলেন, ‘আমার ৫০ লাখ টাকা ছিল। আর অন্যান্যদের (স্বজনদের) দুই তিন কোটি টাকা করে ছিল। এখানে যদি নিরাপদ না থাকে তাহলে আর কাকে বিশ্বাস করব?
তিনি জানান, টাকা তছরূপের ঘটনা শুনে তার চাচা মোস্তফা জামান আব্বাসী প্যারালাইজড হয়ে গেছেন। তার ফুপু, ফুপার টাকাও রয়েছে, তাদের অবস্থাও শোচনীয়।
নাশিদ কামাল বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবন্ধিত হওয়ার পরও আমরা টাকা রাখার যদি কোন আস্থা না পাই, তাহলে কীভাবে হবে?
‘বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যতবার যাচ্ছি তারা বলছেন তারা কিছু জানেন না। এই ঘটনা শুনে আমার জানামতে একজন হার্ট অ্যাটার্ক করে মারা গেছেন।’
আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে ছিলেন খুরশীদ আলম খান। পরে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজকে পিকে হালদারের বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন আমরা আদালতে দাখিল করেছি। একইসঙ্গে ভুক্তভোগী অনেকেই আদালতে তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। আদালত তাদের বক্তব্য লিখিত আকারে দিতে বলেছেন।’