গত এক দশক ধরে স্কুলে স্কুলে নতুন বই বিতরণ মানেই উৎসব। করোনাকাল জীবনের ধাপে ধাপে যে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছে, তাতে বাদ পড়েনি এই বই উৎসবও।
বছরের প্রথম দিন নতুন বই পাচ্ছে বটে শিক্ষার্থীরা। তবে তাতে নেই হৈ হুল্লোর, উৎসব-আনন্দ, সমস্বরে চিৎকার।
আবার সব শিক্ষার্থী এক দিনে পাচ্ছে না বই। স্কুলে স্কুলে একেকটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরকে ডেকে তুলে দেয়া হচ্ছে বই, যা চলবে ১২ দিন।
যদিও শুরুতে বলা হচ্ছিল, প্রাথমিকের বই দেয়া হবে অভিভাবকদের হাতে, কিন্তু বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষার্থীদের কাছেই দেয়া হয় বই।
করোনাকালে সামাজিক দূরত্বের যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে, সেই দূরত্ব বজায় রাখতেই শিশুদেরকে একসঙ্গে আনা হয়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতি বছর ১ জানুয়ারি ঘটা করে স্কুলে স্কুলে বই বিতরণ করা হতো, যা পরিচিতি পেয়েছে বই উৎসব নামে। এবার করোনাকালে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিবেচনা করে ঘটা করে উৎসব না করার সিদ্ধান্ত হয়।
মাগুরা সদর উপজেলার ৭ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন বই হাতে শিশুরাতবে নতুন বই মানেই উৎসব। শিশুরা বই হাতে নিয়ে দল বেঁধে ছবি তুলেছে। দীর্ঘদিন পরে বন্ধুরা একসঙ্গে আনন্দও করেছে।
এবার ভাগে ভাগে ৪ কোটি ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২২৬ জন শিক্ষার্থীর হাতে ৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬২ হাজার ৪১২টি বই তুলে দেয়া হবে।
১ জানুয়ারি থেকে ৩ জানুয়ারি নবম শ্রেণির, ৪ থেকে ৬ জানুয়ারি অষ্টম শ্রেণির, ৭ থেকে ৯ জানুয়ারি সপ্তম শ্রেণির এবং ১০ থেকে ১২ জানুয়ারি ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বই দিতে বলেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বই বিতরণ করা হচ্ছে।
উৎসব নেই ঢাকায়ও
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বই বিতরণ শুরু হয় সকাল ১০টায়।
অধ্যক্ষ কামরুন নাহার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা করোনা পরিস্থিতির কারণে আমার শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিয়ে উৎসব করতে পারিনি এর জন্য একটা দুঃখ রয়ে গেছে। করোনা পরিস্থিতির জন্য আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অভিভাবকদেরকে শুধু আসতে বলেছি।’
এই স্কুলে প্রথম দিন বই পেয়েছে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীরা।
অধ্যক্ষ বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রাণালয় থেকে বই বিতরণের জন্য নিয়ম করে দেয়া হয়েছে। তার জন্য শুরুতে শুধুমাত্র অষ্টম শ্রেণির বই দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য শ্রেণির বই বিতরণ করা হবে।’
মেয়ের জন্য বই নিতে আসা মৌসুমী রায় বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে নতুন বই পেয়ে। বাসায় গিয়ে মেয়ের হাতে তুলে দিতে পারব। এবার করোনার জন্য মেয়েকে নিয়ে আসতে পারিনি। তবে সুষ্ঠুভাবে এত সহজে বই পাব এটা ভাবিনি। করোনার মধ্যেও বাচ্চারা বাসায় ঠিকমতো পড়াশোনা করছে। নতুন বই পেয়ে আরও মনোযোগী হবে।’
রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে অষ্ঠম শ্রেণিতে ওঠা মুরসালিন হোসেন বই নিতে এসেছে মা আছিয়া বেগমের সঙ্গে। প্রায় ৯ মাস পর স্কুলে আসার আনন্দে ভাসছিল সে।
‘এই করোনা মধ্যে নতুন বই হাতে পাব, এটা কল্পনায় ছিল না। যদিও স্কুল বন্ধ থাকার কারণে পড়াশোনা তেমন করতে পারিনি, এই ক্ষতি পুষিয়ে নেব নতুন বছরে’- বলে উচ্ছ্বসিত মুরসালিন।
তার চাওয়া নতুন বছরে করোনার যেন বিদায় হয়। সে বলে ‘স্কুলে যেন আবার ক্লাস শুরু হয়। তার মন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে চাই।’
বরিশালে ১১১নং সিসটারস ডে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হল রুমে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেন জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান।
তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারির মধ্যেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেই কথা চিন্তা করে নতুন বই বছরের প্রথম দিনই বিতরণ করা হয়েছে। সরকারের কাছে শিক্ষার উন্নয়নের প্রাধান্য বেশি।’
বরিশালে সিসটারস ডে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বই নিতে আসা শিশুর দলবরিশাল সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক প্রশান্ত বিশ্বাস, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার লতিফ মজুমদার ও সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহাবুবুর রহমান মধু।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রধান শিক্ষক মাহাফুজা বেগম।
বরিশাল বিভাগে প্রাথমিকের ১২ লাখ শিশু শিক্ষার্থীকে নতুন বই দেয়া হবে।
নেত্রকোণা সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হয় বই উৎসব।
জেলায় মোট ৪৭ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৪ টি বই বিতরণ করা হবে।
সকাল সোয়া ১০টার দিকে জেলা প্রশাসক কাজি মো. আব্দুর রহমান এক শিক্ষার্থীর হাত স্যানিটাইজ করার পর বই তুলে দিয়ে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন।
তিনি বলেন, ‘ছোট ছোট শিশুরা নতুন বই হাতে পেয়ে নববর্ষকে বরণ করবে, এটাই আনন্দ।
তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘তোমরা বাড়িতে বসে পড়াশোনা করবে খেলাধূলা করবে, গান শুনবে, কবিতা আবৃত্তি করবে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনবে।’
সুন্দর সময় কাটানোর কথা বলে তিনি মা, বাবাসহ আশপাশের গরিব, দুখি মানুষদের সহযোগিতা করার উপদেশ দেন।
নেত্রকোণা সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হয় বই উৎসবজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ জানান, জেলায় প্রাক প্রাথমিকসহ প্রাথমিকে তিন লাখ ৯৯ হাজার ৯০৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ৮৭৪টি বই বিতরণ করা হবে।
এরই মধ্যে ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ৭৭২টি বই এসে পৌঁছেছে নেত্রকোণায়। বাকি বই কয়েকদিনের মধ্যে ঢাকা থেকে চলে আসবে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল গফুর জানান, জেলা মাধ্যমিক পর্যায়ে সাধারণ, এবতেদায়ী, দাখিল, কারিগরি মিলিয়ে মোট ৩০ লাখ ৫০ হাজার ৭০০ বই বিতরণ করা হবে। এর মধ্যে ১২ লাখ ২০ হাজার ২২৮টি বই এসেছে। বাকি বই ঢাকা থেকে দ্রুত এসে পৌঁছবে।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর মজুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন বই পেয়ে আনন্দে মেতে উঠে শিশু শিক্ষার্থীরা।
বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে শিশুদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে এ বই বিতরণ করা হয়।
লক্ষ্মীপুরে একটি স্কুলে নতু্ন বই পেয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে শিশুরাএ সময় উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পরিমল কুমার ঘোষ, জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভূঁইয়া, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম ভুলু ও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাছিনা আক্তার প্রমুখ।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনছুর আলী চৌধুরী বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে এবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করা হয়নি। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্ব স্ব আয়োজনে বই বিতরণ করছে।
জেলার পাঁচটি উপজেলার এক হাজার ৩৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই লাখ ৪১ হাজার ৯৫ শিক্ষার্থী এবং নিম্ম মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৩০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী নতুন বই পাবেন।