সমাজের শৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ দমনের দয়িত্বে থাকা অনেক পুলিশ সদস্যই হয়েছেন উচ্ছৃঙ্খল, সময়ে সময়ে জড়িয়েছেন অপরাধেও। এমন খবর মিলেছে হরহামেশাই। বিভাগীয় বিচারের নামে গুরু অপরাধে লঘু দণ্ডই হয়েছে সবসময়, যা থেকে সাধারণদের বন্ধমূল ধারণা ‘পুলিশের সাত খুন মাফ’।
সে ধারণায় চির ধরাল ২০২০ সাল। বিদায়ী বছরে দেখা গেল পুলিশেরও বিচার হয়।
এ বছরের ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সালের নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে করা মামলায় তিনজন পুলিশ সদস্যের যাবজ্জীবন সাজা হয়। সাত বছরের কারাদণ্ড পান পুলিশের দুইজন সোর্স।
২০১৪ সালে পুলিশের হেফাজতে জনি নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় করা মামলাটির রায় দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েস। ২০১৩ সালে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন প্রণয়নের পর বাংলাদেশে এটিই প্রথম পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলার রায়।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন পল্লবী থানার তৎকালীন এসআই জাহিদুর রহমান জাহিদ, এসআই রশিদুল ইসলাম এবং এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু।
তাদের যাবজ্জীবন সাজা ছাড়াও এক লাখ টাকা করে জরিমানা এবং দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দেয়া হয়। জরিমানা ও ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে তাদের।
ক্ষতিপূরণের টাকা ১৪ দিনের মধ্যেই আদায় করা হয়।
২০১৩ সালের নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনে অধীনে সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে যাবজ্জীবন। সেখানে আইনের সর্বোচ্চ সাজা দেয়া হলো, তাও পুলিশ সদস্যদেরই।
২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর মিরপুরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে দুই ভাই ইশতিয়াক হোসেন জনি এবং ইমতিয়াজ হোসেন রকিকে আটক করে পুলিশ। সে রাতেই বড় ভাই জনির মৃত্যু হয় পুলিশ হেফাজতে।
এ ঘটনায় মামলা করেন ইমতিয়াজ হোসেন রকি। ২০১৫ সালে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ২০১৬ সালে শুরু হয় বিচার।
ডোপ টেস্টের জালে মাদকাসক্ত পুলিশেরা
এ বছর সাড়া জাগায় মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের খবরটি। সন্দেহভাজন মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের তালিকা করতে বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে প্রতিটি ইউনিটে গোয়েন্দা নিয়োগ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় চলে ডোপ টেস্ট।
মাদক গ্রহণ ও মাদক নিয়ে মানুষকে ফাঁসানোর অভিযোগে আট পুলিশকে চাকরিচ্যুত করার বিষয়ে কথা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার
মাদক গ্রহণের প্রমাণ পেয়ে চাকরি হারান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ১০ সদস্য। সেবনের পাশাপাশি, মাদক বিক্রি, মাদক দিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিদের ফাঁসানো, উদ্ধার করা মাদক জব্দ তালিকায় কম দেখানোর মতো অভিযোগেরও প্রমাণ মিলে কারও কারও বিরুদ্ধে।
এই পরীক্ষায় ৬৮ জনের মাদক নেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে সাত জন এসআই, একজন সার্জেন্ট, পাঁচ জন এএসআই, পাঁচ জন নায়েক ও ৫০ জন কনস্টেবল।
তাদের মধ্যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে পুলিশের বিভাগীয় মামলা হয়। ১৮ জনকে বরখাস্ত করা হয়। মামলা নিষ্পত্তি শেষে ২২ নভেম্বর ওই ১৮ জনের মধ্যে ১০ জনকেই চাকরিচ্যুত করা হয়।
ডোপ টেস্ট আতঙ্ক ছড়িয়েছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) সদস্যদের মাঝেও। ইতিমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন চার জন।
চলতি মাসে ডোপ টেস্টে পজিটিভ হন বিএমপির ১৭ জন সদস্য। এদের মধ্যে সরাসরি মাদক কেনাবেচায় জড়িত পাঁচ জনকে মাদকসহ গ্রেপ্তার করে পাঠানো হয় কারাগারে।
তাদের বিরুদ্ধে মাদক মামলা করে ওই মামলায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের কারাগারে পাঠানো হয়। বাকি ১২ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে।
চাকরি হারিয়েছেন কুষ্টিয়া পুলিশের আট সদস্যও। গত ৩০ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে এই সিদ্ধান্ত জানান জেলার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত।
বাহিনীর সদস্যদের দুর্নীতিমুক্ত করতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাধিকবার হুঁশিয়ারি শোনা গেলেও কার্যকর ব্যবস্থা দৃশ্যমান হলো ২০২০ সালেই।