নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের জন্য গ্যাস বিতরণ সংস্থা তিতাস, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসির স্থানীয় ১০ জন কর্মীর পাশাপাশি দায়ী করা হয়েছে মসজিদ কমিটির অবহেলাকেও।
মসজিদ কমিটি জেনেশুনে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়েছে। একটি লাইনে বিদ্যুৎ চলে গেলে আরেকটি লাইনের বিদ্যুৎ ব্যবহার করত। আর এই কাজ করা হতো ম্যানুয়ালি।
মসজিদের পাশে পরিত্যক্ত গ্যাস লাইনে লিকেজ ছিল। সেই লিকেজ থেকে মসজিদে জমা হয়েছিল গ্যাস। আর বিদ্যুতের লাইন পাল্টানোর সময় স্পার্ক ( স্ফুলিঙ্গ) থেকে ধরে যায় আগুন। আর এরপর বিস্ফোরণ ঘটে এসির।গত ৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে় ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকার বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটে। এশার নামাজ পড়তে যাওয়া ৩৭ জন মুসল্লি ও এক জন পথচারী দগ্ধ হন। এদের মধ্যে ৩৪ জন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে মারা যান। চার জন এখনও বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
১০ সেপ্টেম্বর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব নেয় তারা। সিআইডি ক্রাইমসিন ইউনিট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহ করে। তারা তিতাসের আট জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ডিপিডিসির দুই জন ইলেকট্রিশিয়ানকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
লিকেজ খুঁজতে মসজিদের আশপাশের এলাকায় মাটি খনন করা হয়। তখন জানা যায়, যে লাইন থেকে গ্যাস মসজিদে ঢুকেছে, সেটি পরিত্যক্ত লাইন ছিল। এক যুগেরও বেশি সময় আগে পরিত্যক্ত হলেও লাইনটি বন্ধও করেনি তিতাস।
সিআইডি জানায়, তিতাসের লাইনে লিকেজ থেকে মসজিদে গ্যাস জড়ো হওয়ার তথ্য মসজিদ কমিটিকে জানিয়েছিলেন মুসল্লিরা। কিন্তু কমিটি তাতে পাত্তা দেয়নি।
গত ৩০ অক্টোবর রাতে মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুল গফুরকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। পরে তাকে রিমান্ডেও নেয় হয়।
সাড়ে তিন মাসেরও বেশি সময় তদন্তের পর বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জ আদালতে এই মামলার প্রতিবেদন জমা দেন সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জিসানুল হক। প্রতিবেদনে এই দুর্ঘটনার জন্য কারা দায়ী, তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মসজিদ কমিটির সঠিকভাবে মসজিদ পরিচালনায় অবহেলা, অব্যবস্থাপনা, উদাসিনতা, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এতে বলা হয়, কারিগরি দিক বিবেচনা না করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ লাগানো হয়।
গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েও মুসল্লিদের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
ডিপিডিসির মিটার রিডিং কালেক্টর ও ইলেক্ট্রিশিয়ানদের দিয়ে মসজিদে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে।
মসজিদটিতে বেশ কয়েকটি এসি লাগানো হয়। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজনীয় লোড নেয়া ছিল না। সিআইডি বলছে, ঝুঁকিপূর্ণভাবে মসজিদে বিদ্যুতের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে।
সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার আগে থেকে তিতাস গ্যাস পাইপের লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে মসজিদে জমা হতে থাকে। বাধাহীনভাবে গ্যাস উদগিরণ হয়ে মসজিদ গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়।
ঘটনার সাত থেকে আট দিন আগে থেকে গ্যাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে মুসল্লিরা বিষয়টি মসজিদ কমিটিকে জানায়। কিন্তু মসজিদ কমিটি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
ঘটনার দিন এশার নামাজের সময় বৈধ লাইনে বিদ্যুৎ চলে গেলে অবৈধ বিদ্যুৎ লাইন চালু করা হয়। এসময় বিদ্যুতের স্পার্ক হয়। তখন জমে থাকা গ্যাসের কারণে আগুন ধরে যায়।
আগুনে মসজিদের এসি, থাইগ্লাসসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আনে পুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাবুল হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর মিয়া মসজিদ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি নেননি। মসজিদের ভেতরে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগে ছিল। তিনি নিজে এ বিষয়ে সব জেনেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। ‘বৈদ্যুতিক সুইচ নষ্ট ছিল। কিন্তু তিনি তা রক্ষণাবেক্ষণ করেননি। গ্যাস লাইনে লিকেজের বিষয়ে তার অবহেলা ছিল।’
নারায়ণগঞ্জ আদালত পুলিশের পরির্দশক আসাদুজ্জামান নিউজবাংলাকে জানান, রোববার এই চার্জশিট ফতুল্লার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে পাঠানো হবে। আদালত সেদিন পরবর্তী আদেশ দেবে।
তিতাসের কর্মীদেরকে আসামি করা হয়নি
তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা/কর্মচারীদেরকেও এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে।
সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই এলাকার তিতাস গ্যাসের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা তাদের দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। গ্যাস লাইনের সঠিকভাবে তদারকি করে পাইপের লিকেজ মেরামত করেননি।
তবে তিতাস ও ডিপিডিসির কর্মীদেরকে এই মামলায় আসামি করা হয়নি।
সিআইডি বলছে, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে এই ঘটনায় নাম আসা তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা/কর্মচারীর বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হবে।