নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবিতে ৪২ নাগরিক চিঠি দেয়ার ১২ দিনে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই বঙ্গভবনের।
রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি এই চিঠি পেয়েছেন। তবে তিনি কোনো নির্দেশনা দেননি।
সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন নন। তাকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে চলতে হয়।
২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে ‘যেরূপ উপযুক্ত বিবেচনা করবেন’ সেভাবে ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ নেন। পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানান রাষ্ট্রপতি। এটা তিনি করতে পেরেছেন, কারণ প্রধানমন্ত্রী তাকে সে সুযোগ করে দিয়েছেন।
তবে এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
বঙ্গভবনের ওই কর্মকর্তা জানান, ওই চিঠির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি কথা বলেছেন কি না, সেটি তারা জানেন না।
রাষ্ট্রপতি কী সিদ্ধান্ত নিলেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি চিঠিটি দেখেছেন। তবে এ বিষয়ে অফিসিয়ালি কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।’
যারা চিঠি দিয়েছেন, তাদের একজন এনজিও কর্মী বদিউল আলম মজুমদার। সুশাসনের জন্য নাগরিক, সুজনের সভাপতি জানান, বঙ্গভবন থেকে তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি। তবে তারা এখনও আশা করে আছেন তাদের দাবি মেনে রাষ্ট্রপতি পদক্ষেপ নেবেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা যেসব অভিযোগ তুলেছি, সেগুলো গুরুতর। এগুলোর তদন্ত হওয়া দরকার। নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধতার আওতায় আনা দরকার। যদি তা হয় তাহলেই ভবিষ্যতে বিভিন্ন সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ সংস্থা অন্যায় করা থেকে বিরত থাকবে, যেটা আমাদের দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করবে।’
চিঠির পর ভোটার ফিরল কেন্দ্রে
দুই বছর আগের একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর যতগুলো উপনির্বাচন বা স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে, সেগুলাতে ভোটার খরা নিয়ে আলোচনা হয়েছে তুমুল।
চলতি বছর ঢাকার তিনটি উপনির্বাচনে ৫ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়তে দেখা গেছে, যদিও সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী ছিল।
গত ১৮ এপ্রিল ঢাকা-১০ আসনের ওই উপনির্বাচনে ভোট পড়ে ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ।
১৮ অক্টোবর ঢাকা-৫ আসনে ভোট পড়ে ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
১৩ নভেম্বর ঢাকা-১৮ আসনে ভোট পড়ে ১৪.১৮ শতাংশ।
৪২ নাগরিকের অভিযোগ ছিল, নির্বাচনের প্রতি আস্থাহীনতার কারণে ভোটাররা কেন্দ্রে যান না।
অবশ্য এই চিঠি দেয়ার নয় দিন পর ২৪টি পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক ভোটার উপস্থিতি দেখা গেছে। সার্বিকভাবে ভোট প্রদানের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড পৌরসভায় সর্বনিম্ন ৪০ এবং পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় ৮৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে।
- আরও পড়ুন: ভোটার ফিরল কেন্দ্রে
২৮ ডিসেম্বরের ওই নির্বাচনে কোথাও ভোটারদের বাধা দেয়া হয়েছে, এমন খবর আসেনি গণমাধ্যমে। তবে সরকারি দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির তিন জন প্রার্থী অনিয়মের অভিযোগ ভোট বর্জন করেন। আর একজন ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন।
এই নির্বাচনে দুটি পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থী জিতেছেন, যার একটি হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে কি নেই
৪২ নাগরিক যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন, সেটি আসলে আছে কি না, এ নিয় আইনি বিতর্কও আছে।
চিঠিতে সই করা বদিউল আলম মজুমদারের দাবি, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মামলার রায়ে আদালত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনঃস্থাপন (রি-স্টোর) করেছে। রায় রিভিয়ের আবেদন করা হলেও আগের রায়ে আদালতের স্থগিতাদেশ নেই।
তবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের মতে, এই ব্যাখ্যা সঠিক নয়। তিনি বলেন ‘এখন তো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নাই।
‘সরকার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ভিন্ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিল। সুপ্রিম কোর্ট একটা রায়ের মাধ্যমে সেই সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। তবে ওই রায়ের রিভিউ এখন বিচারাধীন।’
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায় রিভিউয়ের আবেদনের পর সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে কি না, এ নিয়ে আইনজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক আছে
‘এখন কোনো অভিযোগ এলে রিভিউ শুনানি শেষ করার পর সিদ্ধান্ত হবে কোন প্রক্রিয়ায় তদন্ত হবে।’
উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। তবে এ সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিমকোর্টের নয় আইনজীবী রিট করেন। এরপর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। এরপর রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। সেই আবেদন এখনও নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
রাষ্ট্রপতিকে দেয়া চিঠিতে সই করা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনি লড়াই করা সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বলবৎ নাই, এটা কোথায় আছে? রিভিউ শুনানির জন্য আছে। এর মানে তো এটা নয় যে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল স্থগিত।’
রাষ্ট্রপতি সাড়া না দিলে সবার মতামতের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানান জেড আই খান পান্না।
অভিযোগ ও ইসির জবাব
১৯ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেন দেশের ৪২ নাগরিক।
চিঠিতে আর্থিক অসদাচরণ, কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম, নিয়মবহির্ভূত বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবহার, ইভিএম ক্রয়ে অনিয়ম, অংশীজনের মতামত উপেক্ষা, নির্বাচনি অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া, রিটার্নিং কর্মকর্তা সাক্ষরিত ফলাফলের সঙ্গে কেন্দ্রের ফলাফলের অমিলসহ নানা অভিযোগ আনা হয়।
চিঠিতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের বর্তমান সদস্যরা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্ন গুরুতর অসদাচরণে লিপ্ত। তারা একদিকে গুরুতর আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মে যুক্ত হয়েছেন, যা অভিশংসনযোগ্য অপরাধ। তারা বিভিন্নভাবে আইন ও বিধিবিধানের লঙ্ঘন করে গুরুতর অসদাচরণ করে চলেছেন।
নাগরিকদের মধ্যে রয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান, আকবর আলি খান ও সুলতানা কামাল, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, কামাল হোসেনের স্ত্রী হামিদা হোসেন, কামাল হোসেনের মেয়ে সারা হোসেন, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম ও আহসান এইচ মনসুর, এনজিও কর্মী বদিউল আলম মজুমদার, রাশেদা কে চৌধুরী, খুশী কবীর, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, আইনজীবী শাদহীন মালিক, বামপন্থি রাজনীতিক আনু মুহাম্মদ, আইনজীবী জেড আই খান পান্না, আলোকচিত্রি শহীদুল আলম।
এই চিঠি দেয়ার পরদিন নির্বাচন কমিশনার শাদাহাৎ হোসেন চৌধুরী বলেন, ৪২ নাগরিকের কেউ কেউ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন। তারা সে সুযোগ না পেয়ে নানা অভিযোগ তুলেছেন।
৪২ নাগরিক অভিযোগ তোলার পর আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে এসে জবাব দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা
২৪ ডিসেম্বর নির্বাচন ভবনে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। তিনি তাদের বিরুদ্ধে নানা সব অভিযোগকে উড়িয়ে দেন।
সিইসি তার বক্তব্যে সবগুলো অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, প্রশিক্ষণ ব্যয়ে আর্থিক অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। একাদশ সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে ১৫ বিশেষ বক্তার জন্য দুই কোটি টাকা বরাদ্দই ছিল না। সম্পূর্ণ অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে অভিযোগ আনা হয়েছে।
নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগের জবাবে নুরুল হুদা বলেন, তারা যে গাড়ি ব্যবহার করেন, সেটা একেবারেই সাধারণ মানের।
ইভিএম কেনায় অস্বচ্ছতার অভিযোগের জবাব দিয়ে সিইসি বলেন, ইভিএম কেনায় সরাসরি নির্বাচন কমিশন যুক্ত নয়। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে এই যন্ত্র আমদানি করা হয়। টাকা সরাসরি সরকারি কোষাগার থেকে সেনাবাহিনীকে পরিশোধ করা হয়।
জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অসদাচরণের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তাকেও অসত্য বলেন সিইসি। তার দাবি, নির্বাচন নিয়ে পর্যবেক্ষক বা গণমাধ্যম কোনো অভিযোগ তোলেনি।
৪২ নাগরিকের এই চিঠি বিএনপির ড্রাফট করে দেয়া বলে মন্তব্য করেছেন সরকারের মুখপাত্র তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
অন্যদিকে এই চিঠি দেয়ায় নাগরিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।