বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

প্রমত্তা পদ্মা জয়ের বছর

  •    
  • ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৩:৩৫

বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই বাংলাদেশ আরও একবার তার সক্ষমতা তুলে ধরল বিশ্বে। ১০ ডিসেম্বর সকালে ১৫০ মিটার দীর্ঘ ৪১ নম্বর স্প্যান যুক্ত করে পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারকে। রচিত হয় বাংলাদেশের আরেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

শীতের সকালে কুয়াশায় ঢাকা পদ্মার বুক অনেকটাই তখন শান্ত, স্থির। নদীতে ভাসছে তিন হাজার ৬০০ টনের বিশাল ক্রেন ‘তিয়ান ই’। আর তাতে ঝুলছে পদ্মা সেতুর সবশেষ ৪১তম স্প্যানটি, যার ওজন তিন হাজার ২০০ টন।

১০ ডিসেম্বরের সেই ঐতিহাসিক সকালে বৈরী আবহাওয়া কিছুটা চোখ রাঙাচ্ছিল। তবে দেশ-বিদেশের প্রকৌশলী আর নির্মাণ শ্রমিকেরা দমবার পাত্র নন। ঘড়িতে সকাল ১০টা, কুয়াশা তখনও তীব্র। বিকট শব্দের সাইরেন বাজিয়ে ‘তিয়ান ই’ জানান দেয়, শুরু হয়েছে তার কর্মযজ্ঞ।

কুয়াশার চাদর ভেদ করে স্প্যান নিয়ে ধীর লয়ে সেতুর দিকে এগোতে থাকে ক্রেন। প্রায় ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় ১৫০ মিটার দীর্ঘ ৪১ নম্বর স্প্যান যুক্ত করে পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারকে। রচিত হয় বাংলাদেশের আরেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

দুর্নীতিচেষ্টার অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংকের মুখ ফিরিয়ে নেয়া, রাজনৈতিক বিতণ্ডা, গুজব, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র- সব কিছু পরাজিত করে স্বপ্ন হলো সত্যি। প্রমত্তা পদ্মার বুকে এখন দৃশ্যমান ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতুর পূর্ণাঙ্গ কাঠামো।

বিজয়ের ডিসেম্বরেই বাংলাদেশ আরও একবার তার সক্ষমতা তুলে ধরল বিশ্বে। আগের দিন ৯ ডিসেম্বর শুরু হয় শেষ স্প্যানটি বসানোর আয়োজন। কুমারভোগ ইয়ার্ড থেকে স্প্যান নিয়ে আসা হয় পদ্মা সেতুর নির্ধারিত পিলারের কাছে। বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা দিয়ে সাজানো হয় এটি।

ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বহুমুখী পদ্মা সেতু মূলত দ্বিতল। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে সেতুর কাঠামো। যান চলাচলের জন্য ২২ মিটার চওড়া চার লেন সড়ক হচ্ছে ‍উপর তলায়। সেখানে থাকবে মোট দুই হাজার ৯২৭টি রোড স্ল্যাব। অর্ধেকের মতো রোড স্ল্যাব বসানোর কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।

আর নিচে চলছে একক ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণের কাজ। সেখানে বসানো হবে দুই হাজার ৯৫৯টি রেল স্ল্যাব। এরমধ্যে দুই হাজারের মতো স্ল্যাব বসানোর কাজ শেষ।

পদ্মা সেতুর সবশেষ অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, মূল সেতুর কাজ ৯১ দশমিক ৫ শতাংশ শেষ হয়েছে।

‘আমাদের সবশেষ অগ্রগতি হলো ওভারঅল ৮৩ শতাংশ এবং মেইন ব্রিজের ৯১ দশমিক ৫ শতাংশ শেষ হয়েছে।’

অবশিষ্ট কাজ শেষ হতে আরও বছর খানেক সময় লাগতে পারে, সে ক্ষেত্রে আগামী বছরের ডিসেম্বরের দিকে পদ্মার এপার থেকে ওপারে যেতে ফেরির প্রয়োজন ফুরাবে। দেশের দক্ষিণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে রাজধানীর।

স্প্যানের যোগফলে দৃশ্যমান সেতুর দৈর্ঘ্য ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার হলেও, পদ্মা সেতুর প্রকৃত দৈর্ঘ্য প্রায় নয় দশমিক ৩০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মার ওপর ৪১টি স্প্যান দিয়ে যুক্ত, আর বাকিটা ডাঙায়। এই অংশ তৈরি করা হচ্ছে রড–কংক্রিট দিয়ে, যা ভায়াডাক্ট নামে পরিচিত। সড়কের ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য তিন দশমিক ১৪৮ কিলোমিটার হলেও রেলের ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য ৫৩২ মিটার।

মূল সেতু নির্মাণ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেক প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।

বিদায় ‘তিয়ান ই’

পদ্মা সেতু প্রকল্পে এক বিস্ময় ছিল ‘তিয়ান ই’। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভাসমান ক্রেনবাহী জাহাজ।

পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হওয়ার তৃতীয় দিনে নিজ দেশ চীনের পথে ফিরে যায় ‘তিয়ান ই’। ১৩ ডিসেম্বর মাওয়া ছাড়ে এই দীর্ঘকায় ক্রেন।

চীনে তৈরি তিন হাজার ৬০০ টন ধারণক্ষমতার বিশেষ ধরনের এই ভাসমান ক্রেনের দাম আড়াই হাজার কোটি টাকা। সেতু সংশ্লিষ্টরা জানান, এই ক্রেন ব্যবহারে প্রতিমাসে খরচ পড়েছে ৩০ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে গত ৪৫ মাসে খরচ হয়েছে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা।

পদ্মা সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি চীন থেকে নিয়ে আসে ‘তিয়ান ই’কে। ২০১৭ সালের মার্চে মাওয়া আসার পর ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। আর এ বছরের ১০ ডিসেম্বর ৪১তম স্প্যান বসিয়ে বাংলাদেশ মিশন শেষ করে তিয়ান-ই।

পদ্মা সেতুর স্বপ্ন বুনন

২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর এই সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। তার পরের বছর ১২ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্যে দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু।

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের ৩৫ ও ৩৬ নম্বর পিলারের ওপর ধূসর রঙের সপ্তম স্প্যান বসানোর পর সেতুর এক কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়।

শুরুতে তিন চার মাস পরপর স্প্যান বসানো হতো। তবে ২০১৮ সাল থেকে বদলে যায় পরিস্থিতি। প্রতি মাসে একাধিক স্প্যান বসাতে সক্ষম হয় সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান।

পদ্মা সেতুর ব্যয়

স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে বাস্তবে রূপ দিতে সরকারের মোট ব্যয় হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেতু নির্মাণে ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় একনেক, যদিও কাজ শুরু করতে পারেনি তারা।

২০০৯ সালে ভূমিধস বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নে পরামর্শক নিয়োগ দেয়। এর প্রায় দুই বছর পর পদ্মা সেতুতে যুক্ত করা হয় রেলপথ, ফলে প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায় সেতু নির্মাণের খরচ। ২০১১ সালে একনেকে সংশোধিত প্রকল্পে এই ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি ২০ লাখ টাকায়।

সেতু নির্মাণে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। নদীর তলদেশের মাটির জটিল গঠনের কারণে মাঝনদীতে ১৪টি পিলারের নিচে একটি করে পাইল বেশি বসাতে হয়েছে। যুক্তরাজ্যের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে পিলার জটিলতা নিরসন করা হয়। এ কারণে নকশাও সংশোধন করতে হয়েছে।

সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মূল ডিপিপিতে ১ হাজার ৫৩০ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। তবে পরে দেখা যায়, পৃথিবীর বিরল এই সেতুটি নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে ২ হাজার ৬৯৮ হেক্টর। অতিরিক্ত জমি অধিগ্রহণের ফলে ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকায়।

ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি

সরকারের সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালুর এক বছরের মধ্যেই উঠে আসবে নির্মাণ ব্যয়।

কারণ সেতু চালু হলে দেশের অর্থনীতিতে সামগ্রিক উৎপাদন, সেবা, পর্যটন, শিল্প, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে যে ইতিবাচক গতি তৈরি হবে, প্রথম বছরে তার আর্থিক মূল্য দাঁড়াবে জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশ।

সরকারের সম্ভাব্যতা জরিপে বলা হয়েছে, সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আয় বাড়বে এক দশমিক চার শতাংশ এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে ৭ লাখ ৪৩ হাজার।

টাকার অঙ্কে প্রাপ্তির পরিমাণ হবে ৩৩ হাজার ৫৫৬ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা, যা পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে বেশি।

জাইকার সমীক্ষা ফলও মিলে যায় সরকারের সম্ভাব্যতা জরিপের সঙ্গে। ওই সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন ২১ হাজার ৩০০ যানবাহন চলাচল করবে, ২০২৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে হবে ৪১ হাজার ৬০০।

আর বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ শতাংশ হারে।

এ বিভাগের আরো খবর