বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বছরের নৃশংসতম হত্যা

  •    
  • ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ ১০:০৫

লালমনিরহাটের বুড়িমারী কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া শহীদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে দেয়া হয়। গুজব ছড়ানো হয়, তিনি কোরআন অবমাননা করেছেন। আর ‘আল কোরআনের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো, ইসলামের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’ স্লোগান দিয়ে হামলে পড়ে কয়েক হাজার মানুষ।

২৯ অক্টোবরের বিকেল। অনির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে আসছে লালমনিরহাট সীমান্তে নির্মম এক ঘটনার তথ্য। অতি সংবেদনশীল ঘটনা নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো অনেকটাই সতর্ক অবস্থানে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আসে প্রশাসন থেকে। জানা যায়, ভয়াবহ নৃশংসতা ঘটে গেছে বুড়িমাড়ীতে।

সেখানকার একটি মসজিদে তর্কাতর্কির জেরে আবু ইউনুস মো. শহীদুন্নবী জুয়েল নামে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার পর তার মরদেহ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

শহীদুন্নবী বুড়িমারীর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে গিয়েছিলেন নামাজ পড়তে। সেখানে তাক থেকে কোরআন শরিফ নামানোর সময় দুর্ঘটনাবশত পড়ে যায়। আর এতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তিনি কোরআন অবমাননা করেছেন।

স্থানীয় প্রশাসন গিয়ে শহীদুন্নবীকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যায়। এরপর উন্মত্ত জনতা হামলা করে সেখানে। পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাকে।

এই ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে । ন্যাক্কারজনক এই হত্যার ঘটনায় পুলিশ ব্যবস্থা নেয় তাৎক্ষণিক।

সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ৪৫ জনকে। ১৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেয়া হয়। আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ছয় জন।

শহীদুন্নবী জুয়েল। ফাইল ছবি।

যা ঘটেছিল

লালমনিরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম নিউজবাংলাকে জানান, শহীদুন্নবী জুয়েল ও তার সঙ্গী সুলতান জোবায়ের আব্বাস বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের নামাজ পড়তে যান। এই দুজনের বাড়িই রংপুরে।

শহীদুন্নবী মসজিদের সেলফ থেকে ধর্মীয় বই নিয়ে পড়তে যান। এ সময় তাক থেকে একটি কোরআন শরিফ নিচে পড়ে যায়। এতে কিছু মুসল্লির ধারণা হয়, ইচ্ছা করেই কোরআন শরিফ ফেলে দেয়া হয়েছে। এ ঘটনা নিয়ে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে কোরআন অবমাননার গুজব আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

উত্তেজিত জনতা এক পর্যায়ে মারমুখী হয়ে ওঠে।

খবর পেয়ে সেখানে যান পাটগ্রামের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কামরুন্নাহার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুমন কুমার মোহন্ত, উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল, বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ নেওয়াজ নিশাত, সদস্য হাফিজুল ইসলাম। কিন্তু তারা তাকে (শহীদুন্নবী) রক্ষা করতে পারেনি।

মসজিদের ভেতরে থাকা মুসল্লিরা শহীদুন্নবীকে মারতে মারতে মসজিদের বাইরে নিয়ে আসেন। পরে আরও বেশ কিছু মানুষ জড়ো হয় সেখানে।

শহীদুন্নবীর বন্ধু উপস্থিত জনতার উদ্দেশে হাতজোড় করে মাফ চান। বলেন, তার বন্ধু ভুল করেছে, তাকেও যেন মাফ করে দেয়া হয। মুসল্লিরা কোনো কথার কর্ণপাত না করে দুই জনকেই পেটায়।

ইউপি সদস্য হাফিজুল ইসলাম তখন দুই জনকে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে আসেন।

তখন আশেপাশে থেকে আরও কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের সামনে।

ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করছে সিআইডি। ছবি: নিউজবাংলা

সে সময় ইউএনও, ওসি ও চেয়ারম্যান জনতার উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের চেষ্টা কোনো কাজে আসেনি। ‘আল কোরআনের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো, ইসলামের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’ এমন স্লোগান দিয়ে জনতা হামলা করে পরিষদ কার্যালয়ে। তখন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের প্রাণ রক্ষা করেন কোনোমতে।

এই স্লোগানটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে জামায়াতে ইসলামী। আর ওই এলাকাটিতে স্বাধীনতাবিরোধী দলটির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।

তবে ওসি মোহন্তের সাহসিকতা ও কৌশলের কারণে বেঁচে যান নিহত শহীদুন্নবীর বন্ধু সুলতান জোবায়ের আব্বাস।

জনতা শহীদুন্নবীকে হত্যার পর স্লোগান দিতে দিতে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মরদেহ টেনে নিয়ে যায় বুড়িমারী বাজারের বাশঁকল মোড়ে। সেখানে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে জ্বলা আগুন নেভাতে এগিয়ে আসার মতো কেউ ছিল না।

শহীদুন্নবী জুয়েলের বাড়ি রংপুরের শালবন এলাকায়। তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক লাইব্রেরিয়ান ছিলেন।

পুলিশের ব্যবস্থা

পরদিন পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডির ক্রাইম সিন সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা গুজবের উৎস, অর্থাৎ প্রথমে কে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।

সেই সঙ্গে ঘটনার কোন পর্যায়ে কারা এবং কীভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন সেটি খতিয়ে দেখা হয়।

শহীদুন্নবীর ভাই সাইফুল আলম এই ঘটনায় ৪৩ জনের নাম উল্লেখ ও শত শত অজ্ঞাতপরিচয়কে আসামি করে মামলা করেন।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনে প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ছবি: নিউজবাংলা

পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পাটগ্রাম পুলিশের এসআই শাহজাহান আরও একটি মামলা করেন ৪৯ জনের বিরুদ্ধে।

বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা করেন ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাঈদ মো. শাহ নেওয়াজ নিশাত। এ মামলায় ২২ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত পরিচয় শত শত ব্যক্তিকে।

এই ঘটনা তদন্তে আলাদা কমিটি করে জেলা প্রশাসন। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। জেলা প্রশাসক আবু জাফর নিজেও যান তাদের সঙ্গে।

কমিটি ঘটনার সময় উপস্থিত ব্যক্তিদের লিখিত ও মৌখিক সাক্ষ্য নেয়। পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান, ওসি, বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছাড়াও সাক্ষ্য দেন উপজেলা প্রকৌশলী মাহবুবার রহমান, ইউনিয়ন পরিষদ সচিব মাসুম হোসেন, বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম সৈয়দ আলী, মুয়াজ্জিন আফিজ উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন।

পরে তদন্ত কমিটির প্রধান টি এম এ মমিন বলেন, ‘সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আমরা এটা নিশ্চিত হয়েছি যে ওই মসজিদে পবিত্র কোরআন অবমাননার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি।’

৭ নভেম্বর তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় জেলা প্রশাসক আবু জাফরের কাছে। তিনি তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান।

রংপুরে শহীদুন্নবীর গায়েবানা জানাজায় অংশ নেন স্বজন ও এলাকাবাসী। ছবি: নিউজবাংলা

গুজব ছড়িয়েছিল কে?

স্থানীয়রা জানান, শহীদুন্নবীকে হত্যার সময় এলাকায় তিনটি গুজব ছড়ানো হয়। কোরআর অবমাননার কথা ছড়ানো ছাড়া অন্য দুটি গুজবের একটি ছিল, নাস্তিক হত্যা করলে গুনাহ মাফ হবে। আর পাথর ছুঁড়ে মারলে সওয়াব হবে।

এই গুজবগুলো কারা ছড়িয়েছিল, সেটি এখনও নিশ্চিত নয়।

লালমনিরহাট গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, ‘বুড়িমারীর বিষয়টি তদন্ত চলছে। ভিডিও ফুটেজ আমাদের একমাত্র ভরসা। ফুটেজ দেখে চিহ্নিত করা হচ্ছে আসামিদের। আমরা চেষ্টা করছি ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করার।’

তিনি জানান, এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয় জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন, মসজিদের খাদেম জোবেদ আলী, মোয়াজ্জিন আফিজ উদ্দীন, হত্যা মামলার প্রধান আসামি আবুল হোসেন, মেহেদী হাসান রাজু, গণি কবিরাজ ও রাসেল ইসলাম ওরফে রাজ বিশু।

এ বিভাগের আরো খবর