শতভাগ বিদ্যুতায়নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। স্বাধীন সার্বভৌম এই দেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ-মুজিববর্ষেই সম্পন্ন হচ্ছে গ্রিড এলাকায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের কর্মসূচি।
এর মাধ্যমে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক অঙ্গীকারও বাস্তবায়িত হচ্ছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে দেশের সব মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনার কথা বলা আছে। ৪৮ বছর পর সেই অঙ্গীকার বর্তমান সরকার বাস্তবায়ন করছে।
দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এবং পাহাড় ও অরণ্যবেষ্টিত কিছু দুর্গম এলাকা ছাড়া সারা দেশ এই ডিসেম্বরেই জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে সংযুক্ত হচ্ছে বলে সরকারি সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। যে অল্প কিছু বিচ্ছিন্ন এলাকা আছে, সেগুলোও যাতে মুজিববর্ষেই (আগামী বছরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত) বিদ্যুতের আলোয় উদ্ভাসিত হয়, সে লক্ষ্যেও কাজ করছে সরকার।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘এই ডিসেম্বরেই আমরা সমগ্র দেশবাসীকে গ্রিড এলাকায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন হওয়ার উৎসবে সামিল করবো বলে আশা করছি। অফ-গ্রিড এলাকাগুলোও দ্রুত বিদ্যুতায়নের কাজ চলছে।’
এবারের বিজয় দিবসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পদার্পণ করেছে সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে। মুজিববর্ষ এবং বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী জাতীয় জীবনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই দুইয়ের সন্ধিক্ষণে শতভাগ বিদ্যুতায়ন নিঃসন্দেহে অনন্য এক জাতীয় অর্জন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে যখন ক্ষমতা নেয়, তখন দেশের বিদ্যুৎ খাত ছিল নাজুক অবস্থায়। মধ্যবর্তী ১২ বছরে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার করা এক দেশ থেকে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের দেশে।
এই সময়ে দেশে ছোট-বড় ১১১টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। ফলে ২০০৯ সালে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৮২ মেগাওয়াট, সেখানে এখন হয়েছে ২২ হাজার ৮৮৫ মেগাওয়াট। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২২০ কিলোওয়াট/ঘণ্টা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫১২ কিলোওয়াট/ঘন্টা। বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯৮ শতাংশ। অবশিষ্ট দুই শতাংশের ঘরেও বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে মুজিববর্ষেই।
২০৪১ সাল পর্যন্ত দেশে বিদ্যুতের প্রয়োজন হিসাব করে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন অব্যাহত রয়েছে। এই সময়ে বিদ্যুতে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী বেসরকারি খাত। দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে তাদের অংশীদারিত্ব এখন প্রায় অর্ধেক। বিপুল বিনিয়োগে সক্ষম এই বেসরকারি খাত দক্ষ জনবলে সমৃদ্ধ। কর্মসংস্থানেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এই খাত।
বিদ্যুৎ খাতের এই অগ্রগতি সারা দেশের চিত্র পাল্টে দিয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও আয়বর্ধক নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং তার সদ্ব্যবহারও হচ্ছে। কৃষিতে সেচের কাজে আমদানিকৃত ডিজেল-নির্ভরতা কমে এসেছে। ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে গ্রামাঞ্চলের মানুষ অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। শিক্ষার বিস্তার তরান্বিত হচ্ছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা মানুষের দোরগোড়ায় চলে যেতে পেরেছে বিদ্যুতের সহায়তায়।
সাংবিধানিক অঙ্গীকার পূরণ
শতভাগ বিদ্যুতায়নের অনন্য এই অর্জনের মাধ্যমে সরকার গুরুত্বপূর্ণ এক সাংবিধানিক অঙ্গীকারও বাস্তবায়িত করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে, যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ উল্লিখিত হয়েছে সেখানে, ১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে এই অঙ্গীকার যুক্ত করার মাধ্যমে সমগ্র দেশবাসীকে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আনার দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কেননা তিনি জানতেন, বিদ্যুৎ যেমন উন্নয়নের চাবিকাঠি, তেমনি উন্নত জীবনেরও মূলমন্ত্র। আর বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং দেশবাসীর উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠাকে নিজের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য করে নিয়েছিলেন, সে কথা তো সবারই জানা।
দেশের সকল মানুষকে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আনার সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার কাজও শুরু করেছিল। একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা নেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে দেয়। এর অর্থ পরিশোধ করা হয় বিনিময় প্রথার মাধ্যমে (বার্টার সিস্টেম )। অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য যে অর্থ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাপ্য ছিল তার বিনিময়ে বাংলাদেশ তাদের দিয়েছিল কাঁচা পাট ও চামড়া।
অন্যদিকে, দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) সাধারণ দেশবাসীকে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। যেমন: পল্লী এলাকায় বিদ্যুতায়নের কার্যক্রম গড়ে তোলা এবং সেচ ও নলকূপে বিদ্যুতায়ন করে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো; বিদ্যুৎ গ্রাহকদের মালিকানায় সমবায় ভিত্তিতে বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি গঠন; সমগ্র পল্লী এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য অবকাঠামো তৈরি করা প্রভৃতি।
বিআরইবির ভূমিকা
গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য যে আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগ নেয় বঙ্গবন্ধুর সরকার, সেই প্রতিষ্ঠানই আজকের বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। যদিও বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় সেই প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। তবে শতভাগ বিদ্যুতায়নের মূল কাজ ‘গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা’ নিশ্চিত করতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করছে এই বিআরইবি।
২০১১ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে কাজ করছেন মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন (অব.)। শতভাগ বিদ্যুতায়ন এবং সরকারের সাংবিধানিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের প্রধান কর্মকাণ্ডে একেবারে সামনে ছিলেন তিনি।
২০১১-১২ সালের স্মৃতি উল্লেখ করে জেনারেল মঈন বলেন, ‘তখন গ্রাহক সংখ্যা অনেক কম থাকলেও বিদ্যুৎ ছিল আরও কম। ফলে পল্লী বিদ্যুতের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রামাঞ্চলে গ্রাহকের হামলার শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে সেচ মৌসুমে। অবস্থা এমন হয়েছিল যে এক পর্যায়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রক্ষা করার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫০টি মামলা করতে হয়েছিল বিআরইবিকে। এখন সেচের গ্রাহক তখনকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। তবু কখন সেচ মৌসুম আসে, আর কখন যায়, কেউ টেরও পান না।’
আরইবির চেয়ারম্যান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ‘২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণা দেন তখন, ২০১৩-১৪ সালে বিআরইবির বিদ্যুতায়নের হার ছিল ৩৩ শতাংশ। মোট গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৯৩ লাখ। আর এখন বিদ্যুতায়নের হার ৯৯ শতাংশ। আর গ্রাহক সংখ্যা ৩ কোটি ৩ লাখ। দেশের একমাত্র উপজেলা, মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সর্ব দক্ষিণের রাঙ্গাবালি এবং ভোলা ও সিরাজগঞ্জের আরও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন জনপদের আড়াই লাখ গ্রাহক ছাড়া বিআরইবির এলাকার সকল গ্রাহক এখন বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায়।
তিনি বলেন, ওই আড়াই লাখ গ্রাহককে সংযোগ দেওয়ার জন্য অত্যন্ত প্রশস্ত কয়েকটি নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেব্ল স্থাপন করতে হবে। এর সব প্রয়োজনীয় অবকাঠেমো তৈরি করা হয়েছে। বিআরইবি নিজস্ব অর্থে সাবমেরিন কেব্ল স্থাপন করবে। সে জন্য ২৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। প্রকল্প অনুমোদনের পর কাজটি সম্পন্ন করতে মাস দুয়েক সময় লাগবে। অর্থাৎ এই কাজও মুজিববর্ষের মধ্যেই সম্পন্ন হবে।
বিআরইবির গ্রিডভুক্ত এলাকায় এখন মাইকিং করে জনসাধারণকে বলা হচ্ছে, যদি কোনো বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ না হয়ে থাকে তাহলে অবিলম্বে তা স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে জানাতে। এমন কোনো বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে সেই বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে।
কিছু চ্যালেঞ্জ
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিআরইবি ছাড়াও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি), পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ওজোপাডিকো) এবং নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) কর্মএলাকাতেও দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু এলাকা রয়েছে। আর তিন পার্বত্য জেলায় রয়েছে পাহাড় ও অরণ্যবেষ্টিত দুর্গম এলাকা। এই সবগুলো এলাকায় সকল গ্রাহককে আগামী মার্চ মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় আনা কঠিন। তবে প্রধানমন্ত্রীর ‘২০২১ সালের মধ্যে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ পৌঁছানোর ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছরের মধ্যে এদের সবাইকে নিশ্চিতভাবে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হবে।
এর মধ্যে ওজোপাডিকো এবং নেসকোর এলাকায় গ্রিডের বাইরে (অফ গ্রিড) সকল গ্রাহকের জন্য সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হবে। তিন পার্বত্য জেলায় গ্রিডের বিদ্যুৎ সংযোগ বিপিডিবি। আর অফ গ্রিড এলাকায় সকলকে সৌর বিদ্যুৎ দেওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এই উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা বলেন, ওই প্রকল্পের আওতায় ৪০ হাজার বাড়িতে সোলার হোম সিস্টেম এবং আড়াই হাজার প্রতিষ্ঠানে (স্কুল, কলেজ, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় প্রভৃতি) সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হবে। সরকারি অনুমোদনের প্রক্রিয়া শেষ হলেই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে।