যশোরের অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হুসেইন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) শরিফ মোহাম্মদ রুবেলের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ আনার একদিন পরই উপজেলা সহকারী প্রোগ্রামারকে বদলি করা হয়েছে।
নিরাপত্তার অযুহাত দিয়ে অভিযোগকারী এই কর্মকর্তাকে বদলি করা হলেও যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। জেলা প্রশাসক বলছেন, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অভিযোগকারী নারী কর্মকর্তার বলছেন, আপত্তিকর প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে মানসিক পীড়নের পাশাপাশি হত্যার হুমকিও দেয়া হয়েছে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তারা। তাদের দাবি, অভিযোগকারী নারী কর্মকর্তা কাজে ফাঁকি দিতেন। এ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ায় তিনি বানোয়াট অভিযোগ করেছেন।
ওই নারী কর্মকর্তা লিখিত অভিযোগের পাশাপাশি তার সঙ্গে দুই কর্মকর্তার কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ডও জমা দিয়েছেন। তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা বলছেন, এই রেকর্ড এডিট করে বানানো হয়েছে।
যে অভিযোগ নারী কর্মকর্তার
যশোরের অভয়নগর উপজেলার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের ওই সহকারী প্রোগ্রামার গত ২২ ডিসেম্বর মহাপরিচালক বরাবর কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও জীবননাশের হুমকি দেয়ার অভিযোগ করেন।
তিনি এতে লেখেন, গত ৪ মার্চ তিনি কাজে যোগ দেন। কিন্তু শুরু থেকে ইউএনও নাজমুল হুসেইন খান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তাকেসহ অন্য সহকর্মীদের গালাগাল করতেন। নির্ধারিত সময়ের পর গভীর রাত পর্যন্ত তাকে অফিসে থাকতে বাধ্য করতেন।
এক পর্যায়ে পিআইও শরিফ মোহাম্মদ রুবেলের মাধ্যমে তাকে আপত্তিকর প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় পিআইওকে দিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়।
অভিযোগকারী কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রথমে তাদের ইঙ্গিত বুঝতে পারিনি। পরে তারা সরাসরি সঙ্গ দেয়ার প্রস্তাব দেয়। ইউএনও স্যারের হয়ে পিআইও বলতেন, আমি কেন স্যারের হতাশা দূর করি না। এই হতাশা অন্য কোনো নারী মেটাতে পারে, স্ত্রী নয়।’
তিনি বলেন, ‘ইউএনও স্যার প্রশিক্ষণে যাওয়ার সময় পিআইওকে সঙ্গে পাঠাতে চান। নির্দেশনা দেন, করোনাকালে আমি যেন পিআইওর সঙ্গে মোটরসাইকেলে খুলনায় আসা-যাওয়া করি।’
ওই নারী কর্মকর্তা ও পিআইও দুই জনই খুলনা থেকে অফিস করতেন। নারী কর্মকর্তাকে তার মা-বাবা নিতে আসতেন।
তিনি বলেন, ‘স্যার একদিন বলেন, তাদের (মা-বাবা) আসার কী দরকার? রাতে আপনাকে আকিজে সিট করে দিতে বলি। পিআইও, আমরা সবাই একসঙ্গে না হয় থাকলাম।
‘আমি প্রথম বুঝিনি আকিজ কী? পরে জানতে পেরেছি, আকিজ অফিসের পাশেই একটি সিটি। যেখানে হোটেলসহ অনেক কিছুই আছে। এ ধরনের অনেক নোংরা প্রস্তাব দেয়া হতো।’
তিনি বলেন, “পিআইও ঈদের সময় আমাকে অনেক কিছু কিনে দিতে চান। সেদিন তিনি আমাকে বলেন, ‘একটা ডিল করা যাক, আপনি যখন হতাশ থাকবেন, তখন আমরা আপনার হতাশা কাটাব। মানে, আমাদের টাকায় ঘুরলাম, শপিং করলাম, সিনেমা দেখলাম। আর আমরা যখন হতাশায় থাকব, তখন আপনি আমাদের একটু সঙ্গ দেবেন’। এরপর আমি তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যাই।”
জিডি নেয়নি পুলিশ
বদলি করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ডিপার্টমেন্ট আমাকে সেফ করার জন্য বদলি করছে। তবে, আমি এর বিচার চাই। আমাকে এ বিষয়ে কথা না বলতে ও ফোন বন্ধ রাখতে চাপ দেয়া হচ্ছে। আমি চাপ উপেক্ষা করে ফোন খোলা রেখেছি। দুঃখ হয়, মেয়ের নিরাপত্তা চেয়ে আমার মা-বাবা থানায় জিডি করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তা নেয়নি।’
কী বলছেন অভিযুক্তরা
এই কর্মকর্তার অভিযোগ বেমালুম অস্বীকার করেছেন পিআইও শরিফ মোহাম্মদ রুবেল। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, আমি কোনো কুপ্রস্তাব দিইনি। তাকে ট্যাগ অফিসার নিয়োগ করেছেন ইউএনও স্যার। কাজ বুঝে নিতে চাইলে বুঝিয়ে দিতেন না। অফিস ফাঁকি দিতেন। আমি তাকে বোন বলে সম্বোধন করতাম। কোনো ধরনের বাজে কথা বলিনি। আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছে।’
এই অভিযোগ শোনার পর আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী-সন্তান আছে। তিনি এভাবে হেয় না করলেও পারতেন।’
ইউএনও নাজমুল হুসেইন খান বলেন, ‘সহকারী প্রোগ্রামার কর্মস্থলে যোগদানের পর থেকেই অফিসে সময় দিতেন না। সর্বশেষ তাকে ৪০ দিনের কর্মসৃজনের কাজে ট্যাগ অফিসার নির্ধারণ করা হয়। এতে তিনি ফাঁকি দিতে পারছিলেন না।
‘এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ঘর দেয়ার প্রকল্পের একটি চিঠি দেয়ার শেষ দিন ছিল ২৩ ডিসেম্বর। ২২ ডিসেম্বর পিআইও তাকে ফোন দিয়েছিলেন। তাকে কাজটা করে দিতে সহযোগিতার অনুরোধ করেন। কিন্তু পাঁচটা বাজায় সহকারী প্রোগ্রামার অফিস ত্যাগ করেন। এ নিয়ে তাদের কথা কাটাকাটি হয়েছে। এ সময় উভয়ে কিছু আপত্তিকর কথা বলেছে। কিন্তু অডিও এডিট করে অপপ্রচার শুরু করেছে।’
তিনি বলেন, ‘কোনো প্রমাণ ছাড়াই আমাকে জড়িয়েও আপত্তিকর অভিযোগ দেয়া হয়েছে। আমার রুমে সিসি ক্যামেরা আছে। আমিসহ অফিসে আসা সবাইকে দেখা যায় ও সবকিছু রেকর্ড করা হয়।’
ইউএনও জানান, এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর পাঠিয়েছেন।
তদন্ত হবে
বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘অভিযোগটি শুনেছি। তদন্ত না করে কিছু বলা যাবে না। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’