বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিদ্যুতের তার এসেছে নদীর তলদেশ দিয়ে

  •    
  • ২৬ ডিসেম্বর, ২০২০ ০৮:২৮

শরীয়তপুরের বিচ্ছিন্ন তিনটি চরে বিদ্যুৎ এসেছে এ বছর। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় বদলে গেছে জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য।   

ইঞ্জিনচালিত নৌকায় বিস্তীর্ণ পদ্মা পাড়ি দিয়ে চরআত্রায় নামতেই দেখা হলো ষাটোর্ধ্ব রশিদ সরদারের সঙ্গে। তিনি মরিচের খেতে নিড়ানি দিচ্ছিলেন।

গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে কি না জিজ্ঞাসা করতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। বলেন, ‘বুড়া অইয়্যা গেছি। ভাবদে পারি নাই কারেং দেইখ্যা যাইমু। বাতি জ্বালাইলে গর পওর অইয়্যা যায়। রাইতে সর্ব চরোত পসর অইয়া যায়।’

দেওয়াকান্দি গ্রামের ভেতর ঢুকতে দেখা গেল, ঘরে ঘরে বিদ্যুতের সংযোগ লেগেছে। চরের দরিদ্র মানুষের ঘরবাড়ি একেবারে নাজুক হলেও তাতে বিদ্যুতের সংযোগ।

এক বছর আগেও এই চরে বিদ্যুৎ ছিল না। বিচ্ছিন্ন জনপদ বলে বিদ্যুতের কথা তারা ভাবতেও পারত না। সোলার প্যানেল দিয়ে সীমিত পরিসরে জ্বলত বিদ্যুৎবাতি। ভারী কোনো যন্ত্র চালানো যেত না।

নদীর তলদেশ দিয়ে (সাবমেরিন) কেবলে আসা বিদ্যুতে শরীয়তপুরের তিনটি চর কাচিকাটা, চরআত্রা ও নওয়াপাড়া হঠাৎ করে বদলে গেছে। কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্য আর কলকারখানায় এসেছে নতুন গতি।

শরীয়তপুরের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন পদ্মা-মেঘনাবেষ্টিত ছোট-বড় অসংখ্য চর। এসব চরে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এসব চরে এখন পৌঁছাতে শুরু করেছে বিদ্যুতের আলো।

দেওয়াকান্দি গ্রামে ঢুকে দেখা গেল, মাফিয়া বেগম রান্নার কাজ করছেন। থাকার ঘরটি বেশ ছোট। কাঁচামাটির ওপর নড়বড়ে টিনের ঘর। সেই ঘরে দেয়া হয়েছে বিদ্যুতের সংযোগ।

রান্নাঘরে বসেই কথা হয় মাফিয়া বেগমের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি হিসাব দিতে থাকেন, কীভাবে খরচ বাঁচল তার।

তিনি বলেন, ‘কিরিসত্যাল আংগাইলে কেরোসিন তেল দিয়ে বাতি জ্বাললে আগে একশো দ্যাশশো টাহা লাগদো। আর অহনে যেমন পঞ্চাশ শাইট টাহাই অইয়া যায়।’ (কেরোসিন তেল দিয়ে বাতি জ্বাললে আগে একশ-দেড়শ টাকা লাগত। আর এখন পঞ্চাশ টাকায় হয়ে যায়।)

তিনটি চরে ছোট বড় মিলে রয়েছে ১০টি হাট-বাজার। বিদ্যুৎ পাওয়ায় বাজারগুলোও এখন বেশ জমজমাট। বেড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিধিও।

নওয়াপাড়া বাজারের ব্যবসায়ী মজিবর খা বলেন, ‘আমাগো বাজারে অন্তত ২০০ ব্যবসায়ী আছে। সবাই বিদ্যুৎ পাইছে। আগে সোলার জ্বালাইতাম। ঘরের মধ্যেই আলো ছিল। সন্ধ্যা হইলে মানুষ বেশিক্ষণ বাজারে থাকত না। এহন অনেক রাইত পর্যন্ত মানুষ বাজারে থাকে। আগে এই বাজারে ফ্রিজ ছিল না। এহন অনেক ব্যবসায়ী ফ্রিজ কেনছে। ফটোকপি মেশিন কম্পিউটারের দোহানও হইছে। সব দিক দিয়াই কেনা বেচা বাড়ছে। বিদ্যুৎ পাইয়া চরের ব্যবসায়ীরা লাভবান।’

চরগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে আটটি জাহাজ নির্মাণের ডকইয়ার্ড। এগুলো এতদিন ডিজেল চালিত জেনারেটর দিয়ে চলছিল। ডক ইয়ার্ডগুলোতে শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। ‘মক্কা মদিনা ডক ইয়ার্ড’ পেয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। বাকিরা পাওয়ার অপেক্ষায়।

নওয়াপাড়ার চরমন্ডল এলাকার সততা ডক ইয়ার্ডে গেলে দেখা যায়, সেখানে বাল্কহেড (বালুবাহী ট্রলার) নির্মাণ কাজ করছেন শ্রমিকেরা। কথা হয় মালিক ছানাউল্লাহ ঢালীর সাথে।

তিনি বলেন, ‘মিটারের লিগ্যা টাহা জমা দিছি। আমার পাশের ডকে কারেং পাইছে। অরা দুইড্যা জাহাজও বানাইছে। অগো লাভ হইছে। যেহানে ডিজেলে মাসে খরচ হইতো ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাহা, সেহানে ১০ থেকে ১২ হাজার টাহার কারেং খরচেই হইতাছে। খরচ কমলে আমাগো লাভ বাইরা যায়। এহন অনেকেই তো নতুন কইরা করার চিন্তা করতাছে।’

বরাবরই শিক্ষায় পিছিয়ে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর শিক্ষক সংকট তো রয়েছেই, তার ওপর বিদ্যুতের অভাবে প্রযুক্তিগত জ্ঞান আরোহন ছিল দুঃস্বপ্ন। কেরোসিনের আলোয় বেশি রাত পর্যন্ত পড়াশোনাও ছিল চিন্তার বাইরে। সেই চর এখন গভীর রাত পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মুখরিত। নতুনভাবে গড়ে ওঠা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভিড়।

নওয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইয়াসমীন আক্তার। সাংবাদিক দেখেই এগিয়ে আসে সে। পড়াশোনার কথা বলতেই ঘরে ভেতরের টেবিল দেখিয়ে বলে, ‘এখানেই লেহাপড়া করি।’

তার টেবিলের ওপর একটি বাল্ব। লেখাপড়ার কেমন চলছে জিজ্ঞেস করতে বলে, ‘করোনায় ইশকুল বন্ধ। বাইত্যেই পড়ি। তিন মাস ধইর‍্যা কারেন্ট পাইছি। এহন তেলের চিন্তা করা লাগে না। মায় হেরা ঘুমাইয়্যা থাহে আমি বাতি জ্বালাইয়্যা পড়ি।’

নদীবেষ্টিত হওয়ায় চরে কৃষি ও মাছ চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্ষায় পলি পড়ে উর্বর হয় এসব এলাকার জমি। তাই ফলনও হয় বাম্পার। এখনও বিদ্যুতের সুবিধা পেতে শুরু করেনি কৃষি খাত।

তবে এ বছর বোরো মৌসুমে ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হবে না কৃষকদের। সেচকাজে তারা ব্যবহার করতে পারবেন বিদ্যুৎ শক্তিও। মৎস সংরক্ষণে কয়েকটি বরফকল গড়ে উঠলেও সেগুলোয় চড়া মূল্য দিয়ে সোলার শক্তি ব্যবহার করছেন ব্যবহাকারীরা।

কৃষক উজ্জ্বল শিকদার বলেন, ‘কৃষিতে বিদ্যুৎ লাগলে চরের কৃষি অনেক আউগ্যাইয়্যা যাইব। খরচ বেশি দেইখ্যা অনেক কৃষকই এই কাজ ছাইর‍্যা দিছে। হেরা অহন খেতি কাজ করব। যেই জমিতে এক ফলস হইত, অহন স্যানে দুই তিন ফসল চাষ করোন যাইব। কোলেস্টরেল (কোল্ড স্টোরেজ) হইলে বেশি ফসল সেখানে রাহা যাইব। খ্যাতে পানি দিতে আর ত্যালের ওপর চাইয়্যা থাকতে হইব না।’

জয়বাংলা বাজারের সাব্বির বরফকলের মালিক শাহীন মোল্লা বলেন, ‘সোলারের পাওয়ার হাউসের বিদ্যুতে ইউনিটে দিতাম, ৩০ টাহা আর পল্লী বিদ্যুতে লাগে ১২ টাহা। অর্ধেকেরও কম খরচ। প্রোডাকশনও বেশি করতে পারি। খরচ কইম্যা গেছে আর ব্যবসা বাড়ছে।’

মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২২ এপ্রিল পদ্মার তলদেশ দিয়ে ১ কিলোমিটার পার হয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যেমে তিনটি চরে বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ করা হয় ১০ এমভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন উপকেন্দ্র। বিদ্যুতের খুঁটি ও সঞ্চালন লাইনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

এ বছর ৬ ফেব্রুয়ারি নওপাড়া ও চরআত্রার বিদ্যুতায়নের উদ্বোধন করেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম। এরই মধ্যে ৪ হাজার ৪৫৯ জন গ্রাহকের মাঝে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। ২০২১ সালের ২৬ মার্চের মধ্যে ১৫ হাজার পরিবারের মাঝে বিদ্যুৎ সংযোগ সম্পন্ন করা হবে।

মুন্সীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক এএইচএম মোবারক আলী বলেন, ‘বিদ্যুৎ সংযোগের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি চলমান কাজ। আগামী বছরের স্বাধীনতা দিবসের আগেই শরীয়তপুরের তিনটি ইউনিয়নের সব গ্রামে বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর