বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামাতে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী যৌথ টহল চালাতে একমত হয়েছে। সীমান্ত অতিক্রম না করার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার কর্মসূচি আরও বেগবান করার সিদ্ধান্তও হয়েছে।
ভারতের গোহাটিতে বিজিবি-বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের সম্মেলন শেষে এক যৌথ ঘোষণায় এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
গত ২২ থেকে শুরু হওয়া এই সম্মেলনে আলোচনা হচ্ছে ১০টি বিষয় নিয়ে, যার প্রথমটিই সীমান্ত হত্যা।
এই সম্মেলন শুরুর পাঁচ দিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতীয় সরকার প্রধান নরেন্দ্র মোদির ভার্চুয়াল সামিটেও সীমান্ত হত্যার বিষয়টি আলোচিত হয়। মোদি অঙ্গীকার করেন, বাংলাদেশ সীমান্তে তার দেশের বাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে না।
অবশ্য এই সম্মেলনের মধ্যেই ময়মনসিংহ সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এক বাংলাদেশির প্রাণ যায়।
সম্মেলন শেষ হওয়ার একদিন আগে দুই বাহিনীর যৌথ বিবৃতিতেও প্রধান হিসেবে উঠে আসে সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গ।
গত ২২ ডিসেম্বর ভারতের গোহাটিতে সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়া বিজিবি প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানাচ্ছে বিএসএফ প্রতিনিধি দল।
গত দুই দশক ধরেই এই বিষয়টি দুই দেশেই তুমুল আলোচিত। বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ নিয়ে সোচ্চার। তারা সে দেশের সুপ্রিম কোর্টেও বিষয়টি নিয়ে আবেদন করেছে।
গত এক দশকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমলেও এখনও সীমান্তে রক্তক্ষরণ নিয়ে দেশে ক্ষোভ আছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জাতীয় সংসদে জানান, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে ২৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।
আইন ও শালিস কেন্দ্রের সাম্প্রতিক এক তথ্যে বলা জানানো হয়, গত ১২ বছরে প্রায় ৫৫০ জন বাংলাদেশিকে সীমান্তে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী বিএসএফ। গত প্রায় এক বছরে খুন হয়েছে ৪৫ জন।
দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সম্মেলন শেষে যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্তে বিএসএফ, ভারতীয় নাগরিক, দুর্বৃত্ত কর্তৃক বাংলাদেশের নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা, আহত, মারধরের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
সম্মেলনে বিজিবি প্রধান মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ সর্বদা দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার সম্পর্কের প্রশংসা করে এবং তারা প্রত্যাশা করে যে, বিজিবি এবং বিএসএফ সীমান্ত হত্যার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
ঘোষণায় বলা হয়, ‘সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে অধিক কার্যকরী উদ্যোগ হিসেবে সীমান্তের স্পর্শকাতর এলাকাসমূহে রাত্রিকালীন যৌথ টহল পরিচালনার ব্যাপারে উভয় পক্ষ সম্মত হয়।’
সম্প্রতি লালমনিরহাট সীমান্তে গুলিতে এক বাংলাদেশির মৃত্যুর তিন দিন পর মরদেহ হস্তান্তর করে বিএসএফ
সীমান্তে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারের পাশাপাশি এলাকার জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণসহ সীমান্তে অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণেও দুই পক্ষে একমত হয়েছে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী সীমান্ত হত্যার শিকারদের বেশিরভাগ ভারত থেকে গরু পাচার করে আনতে যায়। তারা সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া কেটে ফেলে প্রায়শ। তখন গুলি করে বিএসএফ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার এ নিয়ে আপত্তি জানালে বিএসএফ একাধিকবার বুলেট ব্যবহার না করার অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু পরে কথা রাখেনি।
এই বিষয়টি এখন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের কাঁটা হিসেবেও ধরা হয়।
সীমান্ত সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখতে এবং অপরাধীদেরকে হত্যার বদলে নিজ নিজ দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানান।
বিএসএফ মহাপরিচালক রাকেশ আস্থানা জবাবে বলেন, সীমান্তে হত্যার ঘটনা অদূর ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে।
সম্মেলনে বিজিবির পক্ষ থেকে সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা-সিবিএমপির ওপর গুরুত্বারোপ করে মাদক পাচার, আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান, গবাদি পশু, জালমূদ্রা, চোরাচালানের মতো অপরাধ দমনে বিএসএফের সহযোগিতা কামনা করা হয়।
লালমনিরহাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশির মরদেহ হস্তান্তরের আগে বিজিবি-বিএসএফের পতাকা বৈঠক
বিএসএফ প্রধানও এ বিষয়ে একমত হন। তিনি বলেন, এই উদ্যোগে দুই সীমান্তরক্ষী বাহিনীই উপকৃত হবে।
প্রচলিত আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে ভারতীয় নাগরিক ও বিএসএফ সদস্যদের প্রায়ই বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার বিষয়েও উদ্বেগ জানান বিজিবি প্রধান। বলেন, এই প্রবণতা দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি এবং অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
পরে দুই পক্ষই নিজেরা সীমান্ত অতিক্রম থেকে বিরত রাখতে উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাস দেয়। জনগণও যেন সীমান্ত অতিক্রম না করে, সে দিকে দুই বাহিনী দৃষ্টি রাখবে বলে জানানো হয়।
সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক ভারতের মিজোরাম রাজ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সশস্ত্র গোষ্ঠীর আস্তানা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সেগুলো ধ্বংস করার অনুরোধ করেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের ‘জিরো টলারেন্স নীতি’উল্লেখ করে বিএসএফ প্রধান বলেন, আস্তানা যদি থাকে, তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সম্মেলনে দুই পক্ষ আগে থেকে না জানিয়ে সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোনো ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ না করার বিষয়েও একমত হয়েছে। পাশাপাশি বন্ধ থাকা উন্নয়নমূলক কাজগুলো যত দ্রুত শেষ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতীয় সরকার প্রধানের মধ্যে ভার্চুয়াল সামিটে সীমান্ত হত্যা নিয়ে আলোচনা হয়
আগামী বছরের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে ঢাকায় দুই বাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের পরবর্তী সীমান্ত সম্মেলন হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়।
বিজিবি মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল এই সম্মেলনে অংশ নেয়।
বিএসএফ মহাপরিচালকের নেতৃত্বে সে দেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ ১২ সদস্যের দল অংশ নেয়। ২২ ডিসেম্বর শুরু হওয়া এ সম্মেলন শেষ হবে ২৬ ডিসেম্বর।