চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি। পাবনার আটঘরিয়ার বাক প্রতিবন্ধী মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে মধ্য বয়সী দুই জনের বিরুদ্ধে।
ঘটনার পরদিন মামলা হয়, গ্রেপ্তার হন আব্দুল করিম ও বিল্লাল হোসেন। এর মধ্যে কেটে গেছে প্রায় ১১ মাস। পুলিশ এখনও শেষ করতে পারেনি তদন্ত।
এরই মধ্যে দুই আসামির একজন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
এমনও না যে, আসামিরা প্রভাবশালী আর ঘটনা নিয়ে জটিলতা আছে। ঘটনার পর পরই আসামি গ্রেপ্তার, চাক্ষুষ প্রমাণও আছে।
তদন্তে এত দেরি কেন?
পুলিশ বলছে, ডিএনএ পরীক্ষার ফল পেতে দেরি হওয়ায় অভিযোগপত্র তৈরি করা যায়নি। তদন্ত কর্মকর্তার দাবি, মামলার সত্যতা প্রমাণে অভিযুক্ত ও ভুক্তভোগীর ডিএনএ পরীক্ষার ফল প্রয়োজন।
তবে ভুক্তভোগীর পরিবার অভিযোগ করছে, ডিএনএ টেস্টের কথা বলে তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে।
ছোট্ট একটা মাটির ঘরে থাকেন ভুক্তভোগী তরুণী ও তার মা। জন্মের দেড় মাসের মাথায় বাবা ছেড়ে চলে যায় তাদের। তারপর থেকে লাপাত্তা। এখন পর্যন্ত স্বামীর খোঁজ জানেন না মেয়েটির মা।
এখনও মুখে কথা ফোটেনি, বয়স যদিও ১৮। মুখ দিয়ে ঝরছে লালা। বাড়ির উঠোনে কজন মানুষ দেখতে খুব বিরক্তি লাগছিল তার। মাঝে মধ্যে চিৎকারও করে উঠছিল।
মেয়েটির মা নিউজবাংলাকে জানান, ঘটনার দিন সকালে ভাইয়ের মেয়েকে পোলিও টিকা দেয়ার জন্য বাড়ির বাইরে যান তিনি। তখন আব্দুল করিম ও বিল্লাল হোসেন তার মেয়েকে ঘরের রশি দিয়ে বেধে ধর্ষণ করেন।
ফিরে এসে দেখেন, করিম দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। মেয়ে তার আহাজারি করছে। ঘরে ঢুকে মেয়ের হাতের বাঁধন খোলার সময়, বিল্লাল দৌড়ে পালিয়ে যান।
‘মেয়ে আমার কথা বলতি পারে না। খালি চিৎকার করে, আর চোখ দিয়ে পানি পড়ি যাই। আমি এসে দেখি করিম দৌড় দিয়ে চলি গেছে। আমার মেয়েডা ছটফট করতিছিল। কথা বলতি পারে না। শরীলডাতে মারের দাগ। এত জোরে ছটফট করিছে যে ঘরের মধ্যে মাটি উঠে গেছে’- বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মেয়ের মা।
করিমকে ওই সময় ধরা যায়নি। তবে মায়ের চিৎকারে আশেপাশের সবাই বিল্লালকে আটক করে। তিনি ধর্ষণের কথা অস্বীকার করেন।
কোনো নির্দিষ্ট কাজ করেন না করিম ও বেলাল। গ্রামের চুরির অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে। অনেকেই দাবি, দুস্থ ও অবহেলিত একাধিক মেয়েকেই ধর্ষণের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। তবে মামলা না হওয়ায় বেঁচে যান সব সময়। অভিযোগ উঠলেই পালিয়ে গিয়ে পরে সুযোগ বুঝে ফিরে এসেছেন।
মেয়েটির মামা নিউজবাংলাকে বলেন, পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা কনক কুমার সরকার মামলার পর করিম ও বেলালকে আটক করে। ওইদিন তার ভাগ্নিকে মেডিক্যাল পরীক্ষা করাতে পাবনা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘পুলিশ আমাদেরকে বলে যেহেতু এটা ধর্ষণ মামলা তাই ঢাকাতে মেডিক্যাল টেস্ট করাতে হবে আসামিদের। এর জন্য মেয়েটির পাজামা নিয়ে যাওয়া হবে। এরপর আসামিদেরকেও ঢাকাতে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে এই যাতায়াত ভাড়ার জন্য তাদেরকে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে।’
মেয়েটির মা বলেন, ‘আমার কাছে ১০ হাজার টাকা চাইলে আমি প্রথমে দিতে রাজি হইনি। তবে এই টাকা নাকি প্রমাণের জন্য লাগবে। এটা জানার পর আমি থানায় আলাদা একটা রুমে তদন্ত কর্মকর্তা কনক কুমারকে ধারদেনা করে নয় হাজার টাকা দিই।
‘মামলার ১৫-২০ দিন পর আমাকে বলা হয় আসামি আর আপনার মেয়ের জামা ডিএনএ টেস্টের জন্য ঢাকা পাঠানো হবে। এর জন্য আমাদের মাইক্রো ভাড়া লাগবে। আমি আমার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে কথা বলি। সে আমাকে জানায় টাকা লাগে না। কিন্তু পুলিশ তো টাকা ছাড়া নড়বে না তাই টাকা দিতে হবে।’
যদিও টাকা নেয়ার অভিযোগকে স্বীকার করতে চান না সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা কনক কুমার সরকার। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটা কখনই সম্ভব না। ভিকটিমের পারিবারিক অবস্থা এত খারাপ যে আমার অনেকবার মনে হয়েছে তাদেরকে টাকা দিই। হয়ত এক আসামি জামিন পেয়েছে। এটা জানার পর তাদের সব ক্ষোভ আমার ওপর পড়েছে।’
কনক বলেন, ‘আমি ওই সময় নিজ খরচে আসামি ও ভুক্তভোগীর কাপড় ঢাকায় এনেছি। এমনকি মেডিক্যাল টেস্ট করার জন্য যে সরকারি খরচ লাগে সেটিও আমি বহন করেছি।
‘মামলার করার সঙ্গে সঙ্গে আমি দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে উপস্থিত করি। আদালতের নির্দেশের সাপেক্ষে অভিযুক্তদের সঙ্গে ভিকিটিমের ডিএনএ মিল আছে কিনা এটা পরীক্ষা করার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসি। করোনা ভাইরাসের জন্য ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) এর পরীক্ষাগার দুইমাস বন্ধ ছিল। দুই মাস পর আবার চালু হয়। আমি বারবার তাগাদা দিলে তারা আমাকে অফিসিয়ালি জানায় টেকনিক্যাল ত্রুটির জন্য দেরি হচ্ছে। সেটিও আমি মামলাতে উল্লেখ করি।’
কনক আরও বলেন, ‘আমি যতদিন ওই থানায় ছিলাম ততদিন পর্যন্ত এই মামলার কার্যক্রম যেন দ্রুত শেষ হয় তার সব চেষ্টা করেছি। কোন ধরনের ত্রুটি রাখিনি।’
এই ১১ মাসে বদলে গেছে অনেক কিছু। আটঘরিয়া থানায় তদন্ত কর্মকর্তাসহ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বদলি হয়েছে। নতুন করে তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন এসআই মোজাম্মেল হোসেন।
এতদিনেও এ ঘটনার কোনো সাড়া শব্দ নেই গ্রামটিতে। পুলিশের কর্মকর্তারা প্রথমে দুই একদিন আসলেও এখন আর কেউ তেমন খোঁজ নিতে আসে না।
নতুন তদন্ত কর্মকর্তা একদিন এসেছিলেন জানিয়ে মেয়েটির মা বলেন, ‘একদিন মোজাম্মেল এসেছিলেন। কিছু সময় দেখা করেন। পরে জামিনে থাকা আসামি বিল্লালের বাড়িতে যান। সেখান যাওয়ার সময় আমাকে সঙ্গে যেতে মানা করেন।’
তিনি বলেন, ‘মেয়ে আমার রাতে ঘুমায় না। চিৎকার করে কান্নাকাটি করে। খিঁচুনি দিয়ে বাথরুম করে ফেলে। এখন তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।’
এ বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জামিনে মুক্ত হন বিল্লাল হোসেন। তিনি গ্রামে ভিক্ষা করেন।
মেয়েটির মার অভিযোগ, বিল্লালের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদেরকে সমঝোতা করতে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কথা না শুনলে ভালো হবে না বলেও হুমকি দেয়া হয়েছে।
আটঘরিয়া থানার বর্তমান ওসি আসিফ মোহাম্মদ সিদ্দিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা এই মাসে (ডিসেম্বরে) ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। আশা করি খুব শিগগিরই আমরা অভিযোগপত্র দিয়ে দিতে পারব।’
প্রতিবেদনে কী এসেছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টেস্টে করিমের ডিএনএ ম্যাচ করেছে। আমরা করিম ও বিল্লালকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট জমা দেবো। বিল্লাল ধর্ষণ কাজে সহযোগিতা করেছে এই মর্মে তাকে আসামি করা হবে।’
টাকা নেয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা আমার থানাতে কখনও সম্ভব নয়। আমাদেরকে প্রতিটা মামলার তদন্তের জন্য আলাদা খরচ দিয়ে দেয়া হয়।’
মেয়েটির মা জানান, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সংগঠন ‘আমরাই পারি’ থেকে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়।
মামলা পরিচালনা ও মেডিক্যালের বিষয়ে ভুক্তভোগীর পরিবারেক সার্বিক সহায়তা করেন এই সংগঠনের স্থানীয় কর্মী আজমেরী হুমায়ুন রনি।