দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেও আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই বলে মনে করে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি।
বৃহস্পতিবার ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়: ঘূর্ণিঝড় আমফানসহ সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে একথা জানায় সংস্থাটি।
সংস্থাটির মতে, ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সুশাসনের ঘাটতির কারণে বছরে ক্ষতির পরিমাণ জাতীয় আয়ের ২.২০ শতাংশ। ঘাটতি দূর করতে পারলে এই বিশাল ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব জানিয়ে ১২ দফা সুপারিশ রেখেছে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সুনাম অর্জন করেছে এবং অনেকক্ষেত্রে কোনো কোনো দেশ আমাদের মডেল অনুসরণও করছে। কিন্তু ব্যাপক অগ্রগতি স্বত্ত্বেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার, জাতীয় আইন, নীতিমালা এবং আদেশ প্রতিপালনে এখনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঘাটতি রয়ে গেছে।’
দুর্যোগ মোকাবিলা নিয়ে সরকারের এক ধরনের আত্মতুষ্টি আছে বলেও মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান।
‘এই আত্মতুষ্টির কারণে দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘকালীন যে সব চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান সেগুলো অবহেলা করা হয় এবং চ্যালেঞ্জ নিরসন করে আরও অগ্রগতির প্রয়াসে ঘাটতি দেখা যায়।
‘তাই আমরা যদি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আরও উৎকর্ষ সাধন করতে পারি তাহলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে জাতীয় আয়ের গড়ে ২.২ শতাংশ বাৎসরিক যে বিশাল ক্ষতি হয় তা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।’ বলেন ইফতেখারুজ্জামান।
২০২০ সালের ১৮ মে থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালকে বেছে নেয়া হয় এই গবেষণায়।
টিআইবি দাবি করে, রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল কম। নিয়মিত সংস্কারের অভাবে ৮৪টি স্থানে ভাঙনসহ ২৩৩ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে জোয়ারের পানি ঢুকে দুর্গত এলাকায় তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। আমফানের আঘাতের ছয় মাস পরেও সাতক্ষীরার আশাশুনিতে বাধ সংস্কার না করায় ঘর-বাড়ি জলাবদ্ধ, গৃহহীন প্রায় ২০ হাজার মানুষ।
দুর্গত মানুষের গৃহস্থালি ও মূল্যবান সম্পদ নিরাপদ স্থানান্তরে প্রয়োজনীয় পরিবহন এবং জরুরি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংস্কার ও পুনঃনির্মাণে পদক্ষেপ গ্রহণে ঘাটতির বিষয় এই গবেষণায় উঠে এসেছে।টিআইবির দাবি, উপকূলীয় অবকাঠামো নির্মাণ, সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে চারটি প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে ০.২৬-১৪০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বিদ্যমান গবেষণায় সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকেই ব্যাপক ঘাটতি দেখা গেছে। যেহেতু বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় ভালো করেছে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে যথেষ্ট প্রস্তুতি ও সক্ষমতাও আছে, তাই বিদ্যমান ঘাটতি ও চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও ভালো করা সম্ভব।’
গবেষণায় প্রাপ্ত ফল ও তথ্য বিশ্লেষণ করে ১২টি সুপারিশ রেখেছে টিআইবি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সতর্কবার্তা পদ্ধতি আধুনিকায়ন করে জনগণের সহজ ভাষায় প্রচার করা; ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা দেয়া; বিপদাপন্ন পরিবার ও এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজ স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করা; ত্রাণ ও পুনর্বাসনের তথ্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তথ্য বাতায়নের মাধ্যমে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা; নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করা এবং এলাকাভিত্তিক পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নিশ্চিত করা; প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতাসহ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যক্রমে দুর্নীতি, অনিয়ম এবং অপচয় বন্ধে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা; প্রকাশিত অনিয়ম-দুর্নীতির স্বচ্ছ তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী ব্যবস্থাপনা বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।