কান্দুনী বালা। ৬০ বছরের এই বৃদ্ধা থাকেন দিনাজপুরের নাগোরপাড়ার সোনারকুড়িতে। নামের মতোই বেদনার্ত তার জীবনে। সরকারি খাস জমিতে কোনো রকম বসতি গড়ে কাটছে জীবন। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তার ওপর উচ্ছেদের ভয়। এভাবেই পার করেছেন জীবনের ছয় দশক।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ কান্দুনীর স্বামী। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র সন্তান মাঠে-ঘাটে কাজ করে যা পায়, তাই দিয়ে টেনেটুনে চলছে জোড়াতালির সংসার।
তবে জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে অনেকটাই দূর হচ্ছে কান্দুনী বালার জীবনের আক্ষেপ। কারণ আর কয়েক দিন গেলেই মিলবে বাড়ি, সঙ্গে পাবেন দুই শতাংশ ভূমির মালিকানা। এমন প্রাপ্তির আনন্দ ঝরে পড়ে কান্দুনী বালার কণ্ঠে।
‘বাহে সরকারে হামাক একনা ঘর দেছে। যাক আপনারা (সরকার) খুব উপকার করেছেন। হামরা উপকার পাইছি। এখন হামাদের ঘর-বাড়ি ভালো হওছে। নাইলে ওইখানকার পাথারত আছি, এখন তাড়াতাড়ি ঘরগুলা চেষ্টা করেন বাবা। হামরা তো জারত (ঠান্ডায়) আছি। সরকার হামাক একখান বাড়ি দেছে এতেই হামরা অনেক খুশি।’
কান্দুনী বালার মতো আনন্দ ছড়িয়েছে সোনারকুড়িতে কোনো রকম জীবন কাটানো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আরও অনেকের মাঝে। সেখানকার ৩১টি পরিবারের জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে পাকাঘর। ১১ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে এসব ঘর নির্মাণ।
বিনা মূল্যে এসব ঘরের মালিকানা পাবে ৩১ পরিবার। এই পুরো আয়োজনটি চলছে মুজিববর্ষকে ঘিরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন মুজিববর্ষে ঘরহীন থাকবে না দেশের কোনো মানুষ।
সোনারকুড়ি পাড়ার ৫২ বছরের ভবেশ গুনজার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই জায়গায় ৩৫ থেকে ৪০ বছর বসবাস করছি। এবার সরকার আমাদের উচ্ছেদ না করে পাকা বাড়ি করে দিচ্ছে। আমরা অনেক খুশি।’
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আক্চায় থাকেন এসিও দাস। কোনো রকমের ভাঙাচোরা ঘর তার। দুই ছেলে আর এক মেয়ের বাবা এসিও দাস ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে পরিবারে সদস্য এখন আট। দুই কামরায় দুই ছেলে তাদের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঘুমায়। এসিও দম্পতির থাকার জায়গা বারান্দায়।
সারা জীবন দারিদ্র্য তাড়া করে বেড়ানো এসিও দাসের সামনেও এখন নতুন বাড়ি পাওয়ার স্বপ্ন।
‘মেম্বার সাবের কাছত নাম দিয়া আসছি। এই শীতত ধাপত আর ঘুমাবা হুবেনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীক ধন্যবাদ হামার মতো অসহায় লোকক বাড়ি করে দিবার তানে।’
মুজিববর্ষে দেশের সব গৃহহীনকে ঘর করে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আর এটি বাস্তবায়ন করছে আশ্রয়ণ প্রকল্প ২। প্রায় ৭০ হাজার ঘর তৈরির জন্য এরই মধ্যে অর্থ ছাড় করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন।
বরাদ্দ করা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করছেন তিনি।
‘মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে দেশের সকল ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য গৃহ প্রদান নীতিমালা’টি ২০২০ সালের ১৩ মে প্রণয়ন করে সরকার। এতে বলা হয়, ক্ষুধামুক্ত ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনের লক্ষ্যে সব ভূমিহীন ও গৃহহীনকে পুনর্বাসন করা হবে।
নতুন বছরে শুরুতে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তত ৫০ হাজার পরিবারের কাছে জমির মালিকানাসহ ঘর হস্তান্তর করবেন প্রকল্পের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগামী জানুয়ারি মাসের কোনো এক শুভ দিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গৃহহীন মানুষের হাতে এই ঘর তুলে দেবেন।’
তিনি জানান, ঘর তৈরির অর্থ জোগাড় করা হয়েছে আশ্রয়ন প্রকল্প, গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান নিউজবাংলাকে জানালেন, প্রতিটি পরিবারই পাচ্ছে একক ঘর, আর দুই শতাংশ জমির মালিকানা।
‘প্রতিটি ঘরে দুইটা বেডরুম, একটা কিচেন, একটা ইউটিলিটি রুম, একটা টয়লেট, একটা বারান্দা থাকবে।
‘এটা কোনো টেন্ডারের মাধ্যমে হচ্ছে না। এই কমিটিকে বলা হয় প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি (পিআইসি)। এদের মাধ্যমে কাজটা হচ্ছে, যার ফলে পুরো টাকাটাই নির্মাণকাজে ব্যয় হচ্ছে। এ কাজে কারও কোনোভাবে লাভ করার সুযোগ নেই।’
ঘর তৈরির হিসাব দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মো. মহসীন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এক লাখ ৭১ হাজার টাকা ঘর, পরিবহনের জন্য চার হাজার, আর কাজটা যারা ইনস্পেকশন করবে তার জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে।’
সারা দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় নয় লাখ গৃহহীন পরিবারের তালিকা হয়েছে বলেও জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব।
‘নয় লাখ পরিবারকে আইডেন্টিফাই করা হয়েছে। আরও আবেদন পড়ছে। সেগুলো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
তৃণমূল পর্যায় থেকে তালিকা নিয়ে সমন্বয়ের কাজটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে করা হচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে থেকে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে তালিকা তৈরি করে কেন্দ্রীয়ভাবে বারবার যাচাই-বাছাই করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সেটি চূড়ান্ত হয়েছে।’
নীতিমালা অনুযায়ী, গৃহহীনদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। যারা ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায়, দরিদ্র, তাদের জন্য সরকারি খাস জমিতে পাকা বা সেমিপাকা ব্যারাক তৈরি করা হচ্ছে।
খাস জমির প্রাপ্যতার ভিত্তিতে দুই শতাংশ জমির মালিকানা দিয়ে একক ঘর তৈরি করে দেয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। আর যাদের এক থেকে ১০ শতাংশ জমি আছে, কিন্তু ঘর নেই, তাদের নিজ জমিতে ঘর তৈরি করে দেবে সরকার।
প্রকল্প পরিচালক মো. মাহবুব হোসেন জানান, এখন পর্যন্ত তালিকায় আসা গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা প্রায় নয় লাখ হলেও এর মধ্যে ভূমি ও গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা দুই লাখ ৯৩ হাজার ৩৬১। পর্যায়ক্রমে প্রত্যেককে ঘর করে দেবে সরকার।
প্রকল্প পরিচালক জানান, বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, বিধবা, এতিম, অসহায়দের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। দেশ ভূমিহীন, গৃহহীন মুক্ত ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্প চলমান থাকবে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি রহিম শুভ ও দিনাজপুর প্রতিনিধি কুরবান আলী)