‘রানতেছিলাম। ঘরে খাওয়ার কিছু নাই৷ লটপটি (মুরগির গিলা-কলিজা) কিন্না আনছিলাম। খালি তেলডা কড়াই দিছি। এর মদ্যে দেহি চিল্লাচুল্লি আগুন ঢুইকা গেছে৷ কিছু বোঝার আগেই ঘরে আগুন ঢুইকা গেছেগা৷ দৌড়াইয়া খুঁজলাম নাতিডি কই। এদিক নাতি খুজতে গিয়া ঘরেত্তে কিচ্ছু পাইলাম না। সব শেষ আমার, সব শেষ।’
মিরপুর ১১ তালতলা বস্তির খিচুড়ি পট্টিতে আগুন লাগার ঘটনায় ঘর হারানো রিজিয়া বেগম এভাবেই বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন৷
তিন ছেলের মধ্যে ছোট ছেলেকে নিয়ে এই বস্তিতে থাকতেন। সেই ছেলে মারা যাওয়ার পর নাতি নাতনিদের নিয়ে থাকা শুরু করেন। বাকি দুই ছেলে গ্রামে থাকে৷
রিজিয়া খাতুন বলেন, ‘ছোট পোলা ঢাকাত আসার পরে আমারে লইয়া আইছে৷ তিন ছেলের মধ্যইন হেই বেশ ভালো পাইত আমারে। এনে ছেলে-বউ দুই নাতি-নাতি নিয়া থাকতাম। অসুখে পোলা মইরা গেল আর বউডা দুই পোলাপান রাইখা চইলা গেল।’
পিতৃহারা দুই নাতির শীতের কাপড়ও ঘর থেকে বের করতে পারেননি রিজিয়া বেগম, এ কথা বলেই কাঁদতে থাকেন তিনি
‘বাজারে ঝাড়ু দিয়া, কাম কইরা সংসার চালাই৷ দুই নাতি-নাতনিরে নিয়া কোনোরকম চলতেছিলাম। এই আগুনে সব নিলোগা। ছোড দুইটা পোলাপান, গরমের কাপড়ডাও নাই। এই ঢাকাত পোলাও নিল। সবই নিল।’
রিজিয়ার মতো এখানে ঘর হারিয়েছেন অর্ধ শতাধিকেরও বেশি পরিবার৷
আগুনে পুড়ে যাওয়া ৫৫টি ঘর থেকে জিনিসপত্র কমই বের করতে পেরেছেন বস্তিবাসী
তাদের মধ্যে আরেকজন মনির হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি পাশে চায়ের দোকানে আছিলাম। আগুন লাগার কথা হুনতেই গেছি৷ কিচ্ছু বাইর করতে পারলাম না৷ দেশ বিদেশ ঘুইরা আমি সব করছি৷ পথ থিকা ঘরে উঠছি, এহন আবার পথেই আইয়া পড়ছি৷’
মনির মৌসুম অনুযায়ী নানা ধরনের কাজ করতেন। কষ্ট হলেও সৌখিনভাবে থাকতে ভালবাসতেন তিনি৷ ঘরের আসবাবপত্র কেনা, ঘর গোছানো ছিল তার শখ।
আগুনে সব পুড়তে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি৷
ঘর থেকে বের করা জিনিসপত্র স্তূপ করে রাখার পর সেখানে হানা দেয় চোরের দল
আগুনে ঘর হারানো, ঘরের কোনোকিছুই বাচাতে না পারা যেমন একরকম কষ্ট। তেমনি জীবন বাজি রেখে কিছু জিনিস অন্তত বাঁচানোর পর সেগুলো চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনায় আরও বেশি হতভম্ভ হয়ে পড়েন ক্ষতিগ্রস্তরা।
আগুনের পর চুরি
আর আগুন লাগলেই এরকম চুরি যাওয়া ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকে৷
রিকশাচালক বাবা ও গার্মেন্টস কর্মী মায়ের একমাত্র মেয়ে সোনিয়া আক্তার৷ প্রসাধনী, শোপিস দিয়ে শোকেইস সাজানোই ছিল তার শখ।
বাবা-মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে টাকা নিয়ে চলে যেতেন গিফটের দোকানে৷
সোনিয়া বলেন, ‘আগুন লাগার সময় আব্বারে আগে কইছি শোকেইস বাইর করতে৷ করছেও৷ পরে কাঁথা বালিশ আনতে গেছি৷ আইয়া দেহি শোকেইসের ভিতরে কিছু নাই৷’
সোনিয়ার বাবা পলাশ মিয়া বলেন, ‘মেয়ের পরে আর পোলামাইয়া নাই৷ সমস্যা। তাই মাইয়া যায় কই হুনতে অয়৷ আদরের৷ খাইতে না পাক, কিয়ের ফুলদানি, এসব কিনে ভইরে ফেলত৷ আমার নিজের ৪৭ হাজার টাকা গেছে। শোকেস আনতে গিয়া ট্রাংক আনি নাই৷ পরে গিয়া আর পাইলামও না৷’
মিরপুর ১১ আদর্শনগরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে দুপুর দেড়টায়৷ পরে ৩ টা ৫৫ দিকে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে৷ ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিকভাবে ৫৫ টি ঘর পুড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছে।