ডাক্তার মো. নুরুস সাফা জাহাঙ্গীর। দাঁতের চিকিৎসক। ডিগ্রি বিডিএস। পরে কলকাতা থেকে উচ্চ শিক্ষা। এই পরিচয়ে এক যুগ রোগী দেখেছেন ঢাকার দুটি চেম্বারে। একটি শান্তিনগর, একটি সিদ্ধেশ্বরী। নাম ওরাল ভিউ ডেন্টাল।
শান্তিনগর বাজারে চেম্বার ছিল আমিনবাগ কো অপারেটিভ মার্কেটের দোতলায়। সিদ্ধেশ্বরীর চেম্বার আনারকলি মার্কেটে।
তবে পরিচয়ের পুরোটাই ভুয়া। আসলে পড়াশোনা করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত।
কিছু রোগী ভুল চিকিৎসার অভিযোগ করেছিলেন র্যাবের কাছে। আর গোয়েন্দারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারে প্রতারণা।
১২ বছর ধরে ডাক্তার পরিচয়ে প্রতারণা করা জাহাঙ্গীর সাজা পেয়েছেন নগণ্য। তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। আর চেম্বার দুটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সোমবার দুপুরে জাহাঙ্গীরের শান্তিনগর চেম্বারে যান র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু। হাতেনাতে ধরা পড়েন দাঁতের ডাক্তার পরিচয়ধার।
মো. নুরুস সাফা জাহাঙ্গীরের ইউনিভার্সাল ডেন্টাল কলেজের ভুয়া সনদ
র্যাব জানায়, বৈধ ডিগ্রি না থাকায় বিএমডিসির (বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) রেজিস্ট্রেশন সনদ নেই জাহাঙ্গীরের। কিন্তু বিএমডিসির বৈধ সনদধারী এক চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিজের বলে চালিয়ে আসছিলেন তিনি।
২০০৬ সালে কলকাতার অলটারনেটিভ মেডিক্যাল কাউন্সিলের জাল বিডিএস সার্টিফিকেট তৈরি করেন জাহাঙ্গীর। নিজেকে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট এর ছাত্র পরিচয়ও দিতেন তিনি।
২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি ডেন্টাল কলেজে থেকে ইন্টার্নশিপের জাল সনদও তৈরি করেছেন।
চেম্বার থেকে এসব জাল সনদ ও দলিল উদ্ধার করেছে র্যাব।
অভিযানের খবর পেয়ে ছুটে আসেন শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা শামছুল হুদা। নিউজবাংলাকে জানান, দাঁতের ছোট্ট সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন জাহাঙ্গীরের চেম্বারে।
তখন জাহাঙ্গীর তাকে বলেন, ১২ টি দাঁত নষ্ট, ক্যাপ পড়াতে হবে। খরচ হবে ৬০ হাজার টাকা।
সন্দেহ হলে অন্য চিকিৎসকের কাছে যান হুদা। সেখানে সমস্যা সারান তিন হাজার টাকায়।
র্যাবের সামনে এত প্রমাণ থাকার পর জালিয়াতির কথা অস্বীকার করতে পারেননি জাহাঙ্গীর। বলেন, ‘আমার কাছে বিএমডিসি এর রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট নাই। আমি বিএমডিসি এর সনদ ছাড়া রোগী দেখে অপরাধ করেছি। আমি আমার দোষ স্বীকার করছি।’
জাহাঙ্গীরের দাবি, তিনি আমি ইউনিভার্সিটি ডেন্টাল কলেজে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ হয়নি।
‘কলেজ থেকে যে টুকু প্র্যাকটিকাল জ্ঞান লাভ করেছি তা দিয়েই এই পেশায় চলছিলাম। আমি আমার ব্যবহারিক জ্ঞান দিয়ে রোগীদের দাঁতের স্কেলিং, ফিলিং, দাঁত তোলাসহ ছোটখাটো অপারেশন করতাম’- ১২ বছর ধরে কী কী করেছেন তার বর্ণনা দিলেন জাহাঙ্গীর।
তার দাবি, তার দ্বারা কোনো রোগীর ক্ষতি হয়নি।
অভিযানে থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা চিকিৎসক মাহমুদুল্লাহ বলেন, ‘দাঁতের চিকিৎসা খুবই সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ। দাঁতের কিছু সার্জারির ক্ষেত্রে রোগীকে অজ্ঞান করার প্রয়োজন পরে, অভিজ্ঞতা না থাকলে রোগীদের জ্ঞান ফিরানো কঠিন।
শান্তিনগর বাজারে চেম্বার ছিল আমিনবাগ কো অপারেটিভ মার্কেটের দোতলায়। সিদ্ধেশ্বরীর চেম্বার আনারকলি মার্কেটে ছিল জাহাঙ্গীরের দুই চেম্বার
‘কারও ডায়বেটিস থাকলে আর সে যদি এমন ভুয়া ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা নেয়, তাহলে ভুল চিকিৎসায় নানা ইনফেকশন এমনকি তার মৃত্যুও হতে পারে।’
ডেন্টাল ক্লিনিকের জন্য যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় তার কোনোটিই মানা হয়নি এই চেম্বারে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, নেই কোনো জীবাণুমুক্ত করার উপাদান। চেম্বার স্থাপনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্রও ছিল না।
সাধারণ মানুষ ভুয়া ডাক্তার চিনবে কী করে- জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি মাহমুদুল্লাহ বলেন, ‘সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সকল চিকিৎসক প্রেসক্রিপশনে ও চেম্বারে তাদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ করতে বাধ্য। সেই নম্বটি বিএমডিসির ওয়েবসাইটে সার্চ করলেই উত্তর মিলবে।’
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নুরুস সাফা নিজেকে স্বীকৃত ডেন্টিস্ট হিসেবে পরিচয় দিয়ে গত ১২ বছর ধরে রোগী দেখে আসছেন। প্রতারণার ফলে রোগীরা স্বাস্থ্যগত ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।’