যশোর সদর পরিবার পরিকল্পনা অফিসের সহকারী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়াসহ নানা অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
যশোরের অভিজাত এলাকা উপশহরে তার স্ত্রীর নামে প্রায় কোটি টাকার পাঁচতলা একটি বাড়ি করেছেন।
তার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে বিভাগীয় তদন্তে অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়। কিন্তু দায়মুক্তি পেয়ে দুর্নীতি ও হুমকির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন।
২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের যুগ্মসচিব মোহাম্মাদ ফজলুল হকের সই করা এক স্মারকে উল্লেখ করা হয়, পরিদর্শিকা কামরুন্নেছা খানমের কাছ থেকে জোর করে ৬৫ হাজার টাকা উৎকোচ নেয়ায় সরকারি কর্মচারী বিধিমালা-১৯৮৫ এর ৩ (বি) ও (ডি) ধারা মোতাবেক তার (মনিরুজ্জামান) বিরুদ্ধে অসদাচারণ ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং বিভাগীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।
অভিযোগ প্রমাণিত হলেও মনিরুজ্জামান সে সময় কোনো শাস্তি পাননি। তার বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিক তদন্ত হয়, কিন্তু সেসবের একটিও আলোর মুখ দেখেনি।
মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) প্রতিটি বিল পাসের বিনিময়ে ১৫০০ টাকা, টিএ বিলের ৪০ শতাংশ টাকা ও শ্রান্তি বিনোদন বিলের ১০ শতাংশ টাকা না দিলে অর্থ ছাড় করেন না বলে বিভাগীয় অভিযোগ করেছিলেন একই কার্যালয়ের চার কর্মচারী তপন কুমার সাহা, রেজাউল ইসলাম, মর্জিনা খাতুন ও তাছলিমা খাতুন।
তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে চুয়াডাঙ্গা জেলার উপপরিচালক দীপক কুমার সাহাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
দীপক কুমার সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তার (মনিরুজ্জামান) বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগ ছিল। কিছু কিছুর সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত রিপোর্ট আমাদের অধিদপ্তরে জমা দিয়েছি।’
যশোর সদর পরিবার পরিকল্পনা অফিসের সহকারী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান
মনিরুজ্জামান প্রায় ১০ বছর ধরে চাকরি করছেন। এখন বেতন ২৭ হাজার টাকা। তা সত্ত্বেও যশোরের অভিজাত এলাকা উপশহরে ডি-১৬১ নম্বর পাঁচতলা বাড়িটি তার স্ত্রীর নামে বলে জানিয়েছেন মনিরুজ্জামান। তার স্ত্রী গৃহিণী। তার আয়ের উৎস সম্পর্কেও কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি মনিরুজ্জামান।
প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, প্রায় পাঁচ আগে মনিরুজ্জামান ১৬ লাখ টাকায় পুরোনো একটি বাড়ি কেনেন। পরে সেটি ভেঙে কোটি টাকার ওই পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করেন। তিনি সপরিবারে ভবনের দ্বিতীয় তলার দুইটি ইউনিটে থাকেন। সেখানে তার শ্বশুর-শাশুড়িও থাকেন। তা ছাড়া অন্য চারটি তলার আটটি ইউনিট ভাড়া দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মনিরুজ্জামানের এক জন সহকর্মী জানান, মনিরুজ্জামানের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশীয়ানী উপজেলার কালনাঘাট সংলগ্ন এলাকায়। সেখানে তার আধাপাকা পৈতৃক বাড়ি রয়েছে। জমিজমা নেই বললেই চলে। তিনি চাকরি সূত্রে ১০ বছর আগে যশোরে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন। কিন্তু ঘুষ বাণিজ্য করে অঢেল টাকা করেন।
সর্বশেষ চলতি বছরও মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত চিত্তবিনোদন ভাতা উত্তোলনে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত পরিদর্শিকা আফরোজা আক্তারকে সহয়তা করার অভিযোগ উঠেছে। ‘দ্য বাংলাদেশ সার্ভিসেস রুলস ১৯৭৯-এর ৮.৪-এর বিধি-৬ অনুযায়ী, প্রতি তিন বছর পর সরকারি কর্মচারীরা চিত্তবিনোদন ভাতা পাবেন। যে বছর চিত্তবিনোদন ভাতা পাবেন, সে বছরে অন্য কোনো উৎসব ভাতা পাবেন না।
আফরোজা আক্তার দুই বছরের মধ্যে দুই বার চিত্তবিনোদন ভাতা পেয়েছেন। পাশাপাশি একই বছরেই দুটি উৎসব ভাতা তুলেছেন।
যশোর সদর পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের পরিদর্শকা আফরোজা আক্তার ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারী ব্যাংক থেকে চিত্তবিনোদন ভাতা তোলেন। একই বছর তিনি দুটি উৎসব ভাতাও তুলেছেন।
সরকারি নিয়মানুযায়ী, ২০২১ সালে তার পরবর্তী চিত্তবিনোদন ভাতা পাওয়ার কথা। অথচ ২০২০ সালের ২৯ জুন তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পরবর্তী চিত্তবিনোদন ভাতা জমা হয়।
এ সম্পর্কে আফরোজা আক্তার বলেন, ‘আমি কবে টাকা পেয়েছি, সেটা আমার মনে নেই। মনির (অফিস সহকারী মনিরুজ্জামান) ভাই সব জানেন, তার থেকে বিস্তারিত জেনে নিন। এ সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। আমার বলার কিছু নেই।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি সার্ভিস বুকের বাইরে কিছু করিনি। আমার বিরোধীপক্ষ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কারণ আমি কর্মচারী সমিতির খুলনা বিভাগীয় সেক্রেটারি।’
অনিয়মের তথ্য প্রমাণ দেখালে তিনি আর কিছু বলতে রাজি হননি।
যশোর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুন্সি মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই ঘটনা সম্পর্কে আমি অবগত নই। বিধিবিরুদ্ধ কিছু হয়ে থাকলে, সেটা দেখার দায়িত্ব সদর উপজেলা মেডিক্যাল অফিসার রফিকুল ইসলাম খানের, এসব তার এখতিয়ারাধীন।’
এ সম্পর্কে রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘ফাইলপত্র সব মনিরের কাছে থাকে। এ ধরনের কোনো কিছু হওয়ায় কথা না। মনিরের সাথে যোগাযোগ করলে সে বিস্তারিত জানাতে পারবে।’