স্বাধীনতাবিরোধীর নাম পাল্টে মুক্তিযুদ্ধের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে করা স্কুলের নাম আবার পাকিস্তানের দালালের নামে হয়েছে। ৪৫ বছর আগে এই ঘটনা ঘটলেও কেউ স্কুলের নামে হাত দেয়নি।
ঘটনাটি ঘটেছে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলায়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ চালাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর দালাল শান্তি কমিটির নেতা মুনছুর আলীর নামে চলছে একটি স্কুল। নাম ‘সাফদারপুর মুনছুর আলী অ্যাকাডেমি’।
মুক্তিযুদ্ধের পর এই স্বাধীনতাবিরোধীর নাম মুছে দিয়ে স্কুলের নাম করা হয় বঙ্গবন্ধু দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয় (সাফদারপুর)। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আবার পাকিস্তানি দালালের নামে করা হয় স্কুলটি।
মুনছুর আলী ওই এলাকার বাসিন্দাও নন। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার মানুষ তিনি। ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ও মুসলিম লীগের (আইয়ুব খান) অনুসারী।
কোটচাঁদপুরের সাফদারপুর গ্রামে ১৯৬০ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। নাম ছিল সাফদারপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। মুনছুর আলী সে সময় স্কুলটিতে কিছু অর্থ সহায়তা করলে তার নামে রাখা হয় স্কুলটি।
বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দিয়ে স্বাধীনতাবিরোধীর নামে স্থাপনা দেখে ক্ষুব্ধ মুক্তিযোদ্ধারা।
কোটচাঁদপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার তাজুল ইসলাম বলেন, ‘মুনছুর আলী একজন কুখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। এখনও তার নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলছে। এর পরিবর্তনের উদ্যোগ নেই। এটা দুঃখজনক।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু আহম্মেদ বলেন, ‘মুনছুর আলী একজন তালিকাভুক্ত রাজাকার। জাতির জনকের নাম মুছে দিয়ে তার নামে স্কুল চলবে যখন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া দল ক্ষমতায়। এটা কীভাবে মানি বলেন?’
জেলার আরেক উপজেলা শৈলকুপায় সরকারি একটি স্থাপনাই পরিচিত শান্তি কমিটির আরেক সদস্যের নামে। ত্রিবেনী ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের পোস্ট অফিসটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘শফিপুর পোস্ট অফিস’ হিসেবে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শফিউদ্দিন শান্তি কমিটির যশোর জেলার সভাপতি ছিলেন।
ঝিনাইদহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার মকবুল হোসেন বলেন, ‘শফিউদ্দিন ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী। তার নামে এখনও প্রতিষ্ঠান থাকা মানে স্বাধীন দেশের অপমান করা।’
ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। সত্যতা পেয়েছি। বিস্তারিত তথ্য প্রমাণ হাতে পেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নিদের্শনা দেওয়া হবে।’
রিট করে মুছতে হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীর নাম
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় কলেজ থেকে রাজাকারের সংগঠকের নাম মুছতে উচ্চ আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
ওই স্বাধীনতাবিরোধীর নাম এ এন এম ইউসুফ ছিলেন। মুসলিম লীগের এই নেতা স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে রাজাকার বাহিনী গঠনে এলাকায় রাখেন ভূমিকা।
উপজেলার ব্রাক্ষণবাজার ইউনিয়নের দাউদপুর গ্রামের এই নেতা অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন।
১৯৯৫ সালে নিজ এলাকায় ইউসুফ-গণি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই নামকরণ নিয়ে সোচ্চার হন মুক্তিযোদ্ধারা।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনসহ কয়েকজন হাইকোর্টে একটি রিট করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে শিক্ষা অধিদপ্তর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে রাজাকারদের নাম বাদ দিতে বলে। তখন কলেজের নাম পাল্টানো হয়।
কলেজের অধ্যক্ষ শাহ্ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠাকার সময়ে কলেজটির নাম ছিল ইউসুফ-গনি কলেজ। শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশে সেটার নামকরণ করা হয়েছে এম এ গনি আদর্শ কলেজ।’
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় এই কলেজটি থেকে রাজাকার বাহিনীর সংগঠক এ এন এম ইউসুফের নাম বাদ দেয়া হয় হাইকোর্টের আদেশের পর। ছবি: নিউজবাংলা
স্বাধীনতাবিরোধী ইউসুফের বাবা ছিলেন গনি। তিনি স্বাধীনতার আগেই মারা যান। এই জায়গাটি তার নামেই ছিল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ চৌধুরী ঝুনু মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইউসুফ মোক্তার রাজাকারদের সংগঠিত করেছেন, তাদের ভরণ-পোষণ করেছেন। তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন যুক্তিযুক্ত।’
কুলাউড়া উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা সহকারী কমান্ডার মাসুক মিয়া বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে যেখানেই মুক্তিযোদ্ধের বিরোধীদের নামে প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো চিহিৃত করে নাম পরিবর্তন করতে হবে।’
কুলাউড়া উপজেলা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনোয়ার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিনি (ইউসুফ) মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তার নামটা বাদ দেয়া হয়েছে। এটির পাশাপাশি কুলাউড়া মাহতাব-ছায়েরা নাম পরিবর্তন করে কুলাউড়া মডেল স্কুল নাম দেয়া হয়েছে।’
বহু স্থাপনায় এখনও স্বাধীনতাবিরোধীর নাম
স্বাধীনতাবিরোধীর নামে স্থাপনার বিষয়ে উষ্মা জানিয়েছে খোদ হাইকোর্ট। এসব নাম পাল্টাতে আট বছর আগে দেয়া হয়েছে নির্দেশ। কিন্তু এর বাস্তবায়ন হয়নি।
দুই দফায় সময় বাড়িয়েও আদালত আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিষয়টিকে ‘অত্যন্ত দুঃখজনক’ বলছেন রিটকারীরা।
স্থাপনা ও সড়ক থেকে রাজাকার ও আলবদরদের নাম মুছে ফেলার নির্দেশনা চেয়ে ২০১২ সালে হাইকোর্টে রিট করেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির।
ওই বছরের ১৪ মে স্থাপনা থেকে দুই স্বাধীনতাবিরোধী নেতা খান এ সবুর ও শাহ আজিজুর রহমানের নাম বাদ দেয়ার নির্দেশ আসে। ২০১৫ সালে এই নির্দেশ বাস্তবায়ন হয়।
সে সময় একটি রুলও জারি করে আদালত। এতে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের নামের স্থাপনা কেন মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।
কিন্তু আদেশের বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৯ সালে স্বাধীনতাবিরোধীদের নামসহ একটি তালিকা করে হাইকোর্টে সম্পূরক আবেদন করা হয়। এতে ২০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া হয়, যেগুলো এখনও স্বাধীনতাবিরোধীর নামে রয়েছে।
রিটকারীর আইনজীবী একে রাশিদুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দুই দফায় সময় বাড়িয়ে আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। বিষয়টি আবার আদালতে নজরে আনব।’
মুনতাসির মামুন বলেন, ‘আদেশ বাস্তবায়ন হয় কি না সে সম্পর্কে হাইকোর্টের কোনো মনিটরিং কমিটি নাই। আমরাও পারি না। এটা দেখবে মন্ত্রণালয়।’
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘কোর্টের মনিটরিং করার কোনো সুযোগ নাই। বাদীপক্ষকেই সবসময় দায়িত্বটা নিতে হয়। আদেশ বাস্তবায়ন না হলে উনারা কোর্টের নজরে আনতে পারেন, সরকারকেও বলতে পারেন।’
আরেক রিটকারী শাহরিয়ার কবির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা সরকারের মর্যাদার প্রশ্নও বটে। কীভাবে স্বাধীনতাবিরোধীর নামে এখানে এখনও স্কুল থাকে?’