মামলার রায়ের পর কপি পেতে বিচারপ্রার্থীদের যেন আদালতের বারান্দায় দিনের পর দিন ঘুরতে না হয় সে জন্য বিচারকদের বিশেষ নজর দিতে বলেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। একই সঙ্গে মামলাজট কমাতে বিচারকদের আরও বেশি কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
শুক্রবার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এক ভিডিওবার্তায় তিনি এসব কথা বলেন।
সুপ্রিম কোর্ট অডিটোরিয়ামে এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, আপিল বিভাগের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি হামিদ বলেন, ‘বিচারকদের খেয়াল রাখতে হবে মামলার রায় হওয়ার পর রায়ের কপি পাওয়ার জন্য বিচারপ্রার্থীদের যেন আদালতের বারান্দায় দিনের পর দিন ঘোরাঘুরি না করতে হয়।’
দিন দিন মামলার সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তা কমাতে বিচারকদের আরও বেশি কাজ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এবং বিচারকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।’
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘দেশের সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। একজন বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার তার অধিকার। আর নাগরিকের সে অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য; দয়া বা আনুকূল্যের কোনো বিষয় না।’
দেশ, জনগণ ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট সবাই তাদের মেধা ও মনন প্রয়োগের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন বলে এ সময় আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। আমাদের সংবিধান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংবিধানসমূহের মধ্যে অন্যতম, যাতে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার এবং আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার প্রদান করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের যাত্রা শুরুর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের প্রথম ধাপ পূর্ণ হয়। আর সুপ্রিম কোর্ট পবিত্র সংবিধানের অভিভাবক।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তারা বহুকাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রকে চিরতরে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে দেশে সামরিক শাসন জারি করে।
‘নিজেদের স্বার্থে জাতীয় সংসদকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে ৫ম ও ৭ম সংশোধনী এনে সেসব কুকীর্তিকে বৈধতা দেয়ার হীন চেষ্টা করেছিল।’
সুপ্রিম কোর্ট সেই সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন সুসংহত করতে সর্বোচ্চ আদালত প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। সুপ্রিম কোর্ট মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ও সংবিধানকে রক্ষা করেছে এবং করে যাচ্ছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, উন্নয়নের সঙ্গে ন্যায়বিচার এবং আইন-আদালতের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বিরোধ মীমাংসা যথাযথভাবে না হলে আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে। বিচার ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি করে জনগণের ক্ষোভ প্রশমন করে। এতে সমাজে বৈষম্য দূরীভূত হয় এবং রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। আর এভাবেই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।
তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, দেশের আদালতে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল ও দুর্গত বিচারপ্রার্থীগণ মামলার শুরু থেকে নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত সব আইনগত সহায়তা পাবে।’
তথ্যপ্রযুক্তি এখন দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ‘করোনা মহামারিতে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিচার কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আদালত প্রাঙ্গণে শারীরিক উপস্থিতি ব্যতিরেকে বিচারপ্রার্থী জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এ সময় আদালতের সব কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতিতে করার ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।’
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘বিচারের সমতা নীতির মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জনে কাজ করছি। কারণ জনগণের আস্থাই বিচারকদের বড় সম্পদ। করোনার ক্রান্তিকালে ভার্চুয়ালি বিচার বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।’
এ পদ্ধতিতে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে উল্লেখযোগ্য হারে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিচারপ্রার্থীদের কষ্ট লাঘবে বিচারকদের ছুটিও বাতিল করা হয়েছে। এসময় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচারকদের সচেষ্ট থাকার আহ্বান জানান প্রধান বিচারপতি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, করোনার দুঃসময়েও দেশে বিচারকাজ চালু রেখে বিচার বিভাগ অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিগত ৪৮ বছরের পথচলায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বহু উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। দেরিতে হলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও জেলহত্যা মামলার বিচার এবং ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের অবদান ভুলবার নয়।
‘দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল তা থেকে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের কথা জাতি আজীবন স্মরণ রাখবেন।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি- আজকের বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু এ অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য যে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছিল তা স্মরণ না করলে ভবিষ্যত পথচালয় ভ্রান্তি হতে পারে।’