বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পদ্মা সেতু: কেমন আছেন বাস্তুচ্যুতরা

  •    
  • ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০ ০৮:৩২

‘বাপ দাদার ভিটের জন্য মনডা কান্দে। কিন্তু দেশের লাইগ্যা ছাড়ছি, এইডার আনন্দ আছে। তয় সরকার অহন আমাদের প্লট রেজিস্ট্রেশন করে দিতাছে। শুনছি, কাজের লাগি ট্রেনিং দিব।’

গল্পটা ফরহাদ মিয়ার। হাতের কড়িতে গোনা বয়সের হিসাবটা ৩০ বছর পার হয়নি। বছরখানেক আগেও এই তরুণ ছিলেন প্রবাসী। থাকতেন সৌদি আরবে। ভালো মন্দ মিলিয়েই চলছিল।

বেশ কয়েক বছর আগে বিদেশে বসেই শুনতে পেলেন পদ্মা সেতু হচ্ছে, দক্ষিণাঞ্চলে আসছে রেল। বদলে যাবে গ্রামের চিরচেনা রূপ। শুনেই আনন্দ।

তার কিছুদিন পর কানে এলো হারাতে হবে বাপ-দাদার ভিটে। স্বপ্নের পদ্মা সেতুর জন্য ছাড়তে হবে তাদের পুরো জমি। তখন মনটা কেঁপে উঠেছিল ফরহাদের।

নদী ঘেঁষে পাঁচ কাঠা জমি ছিল তাদের। বাপ-দাদার ভিটা বলতে ওইটুকুই ছিল সম্বল। এখন অবশ্য সেই কষ্ট কাটিয়ে উঠেছে ফরহাদ। সরকার তার পাঁচ কাঠা জমি নিলেও বাড়ি করতে দিয়েছে পাঁচ শতাংশ জমি। সঙ্গে জুটেছে নগদ অর্থ আর ছেড়ে আসা বাড়ির মূল্য।

ফরহাদের মতো আরও অনেকের আশ্রয় হয়েছে নাওডোবা পদ্মা সেতু পুনর্বাসন প্রকল্পে। পদ্মা সেতুতে ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে মোট আটটি পুনর্বাসন কেন্দ্র করেছে সরকার। তিনটি মাওয়া প্রান্তে। পাঁচটি জাজিরা প্রান্তে।

ফরহাদ এখন গ্রামমুখী। সৌদি আরব ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাতেও পড়েছে ভাটা। বদলের হাওয়া গা মেখে নতুন কিছু করার ইচ্ছার কথা বললেন তিনি। তবে ঠিক গুছিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি এখনও। আপাতত ঘাটে একটা দোকান দেয়ার চিন্তা আছে তার মাথায়।

তবে বাবাকে নিয়ে একটু চিন্তিত এই তরুণ। আগে চরে কৃষি কাজ করতেন। এখন আর সেই উপায় নেই।

‘বাপ দাদার ভিটের জন্য মনডা কান্দে। কিন্তু দেশের লাইগ্যা ছাড়ছি, এইডার আনন্দ আছে। তয়, সরকার অহন আমাদের প্লট রেজিস্ট্রেশন করে দিতাছে। শুনছি, কাজের লাগি ট্রেনিং দিব।’

সব মিলিয়ে পুনর্বাসন হওয়া এলাকায় ভালো আছেন ফরহাদ ও তার পরিবার।

শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে নাওডোবায় বসতি গড়েছে প্রায় ৫৩০ পরিবার। সবুজে ঘেরা এই পল্লিতে সরকার শুধু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিজের ভূমিটুকু বুঝিয়ে দিয়েছে। ঘর তোলার দায়িত্বটা পড়েছে পুনর্বাসিত মানুষের কাঁধে। অবশ্য এর জন্য তাদের টাকা দেয়া হয়েছে।

তবে পুনর্বাসিত এলাকার রাস্তাঘাট সব পাকা। আশপাশের পুরোটা অঞ্চলজুড়ে সবুজের সমারোহ। ছায়া সুনিবিড় এসব পথে শিশুরাও বেড়ে উঠছে শৈশবের দুরন্তপনায়।

ঠিক মাঝখানে খনন করা হয়েছে একটি পুকুর। চারপাশে আছে ঘাট। সেখানেও দেখা গেল মাঝবয়েসী মানুষের অবাধ সাঁতার। পুকুরের এক কোনায় আছে একটি মসজিদ।

একটু এগিয়ে যেতে দেখা হয় সিরাজ শেখের সঙ্গে। ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ। জানালার পাশে বসে অবাক বিস্ময়ে কী যেন দেখছিলেন। কথা হয় তার সঙ্গে।

সিরাজ শেখ বললেন, ‘আমার বাড়ি আছিল গওহর মুন্সী কান্দির ওই দিকে। পদ্মা সেতুর জন্য জাগা নিয়ে গেল, তারপর আমাদের জাগা দিছে।’

তবে জমিজমা হারিয়ে এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তিনি। তাই একটু অভিমান আছে তার কণ্ঠে।

‘না, তেমন একটা খুশি না; এইহানে অশান্তি বেশি। কামাই রুজি নাই। কথাটা বোঝেন নাই? ওইহানে জমি টমি আছিল চাষ কইরা খাইতে পারছি। এইহানে কোনো কামই নাই, ইনকামও নাই।’

ক্ষতিপূরণ নিয়েও কথা হয় এই প্রবীণের সঙ্গে। বললেন, ‘না দিছে, সাত লাখ করে টাকা দিছে আমাগো। ধরেন বিঘা তিনেক জমি ছিল। আর এইহানে ঘর তুলতে দিছে আড়াই শতাংশ। আর ক্যাশ টাকা দিয়ে দিছে।

‘কোনোরকম চরে ভদ্রে যাইয়া টাইয়া কাজ কইরা খাই আরকি।’

এভাবেই চলছে তার পড়ন্ত সময়।

সিরাজ শেখের মতো সখিনা বানুরও আছে কর্মহীন হওয়ার দুঃখ। তবে আগের চেয়ে ভালো আছেন বলেও জানালেন তিনি। কিন্তু আগে টুকটাক আবাদ আর হাঁস-মুরগি পালতেন তিনি।

‘ওইহানে ধরেন কাম কাজ করছি। ধান পাইছি। জায়-জিরাত পাইছি। এইহানে আর হেইয়া নাই। এইহানে খাইয়া দাইয়া বইয়া থাকি। কুনো কাজ কাম নাই। আবাদ করার জাগা নাই।’

সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে যা পেলেন সেটা দিয়ে কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। বলছেন দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

‘টাকা কি থাকেনি? টাকা থাকলে বড় মাছ কিনতে মন চায়। পয়সা পাইছি, তাই খাইয়া শেষ করে ফেলাইতেছি।’

গৃহবধূ রোকসানা ভালো আছেন। অকপটে স্বীকার করলেন সে কথা। বললেন, ‘ভালোই এহানে, কুনো সমস্যা নাই।’

তবে ভিটে হারানোর বেদনাটা মনের কোনো উঁকি মারে আজও। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, ‘বাড়ি গেছে, চক গেছে। চকের জমিনও নিছে, বাড়ির জমিনও নিছে। পদ্মা সেতুতে পড়ছে অইল ক্ষেতের জমিন। আর রেল সড়কে পড়ছে অইল বাড়ির জমিন। দুনো জাগাই আমাদের নিছে। তো ক্ষতিপূরণ দিছে।’

পুনর্বাসন এলাকার শিশুদের কথা ভেবে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে দিয়েছে সরকার। ২০১৭ সালে চালু হওয়া নাওডোবা পদ্মা সেতু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ৩২৭।

প্রধান শিক্ষক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সন্তানরা এখানে অগ্রাধিকার পাবেন। এ ছাড়াও আশপাশের শিশুরাও ভর্তি হচ্ছেন।

‘স্কুলটা হওয়াতে পুনর্বাসনে যারা আসছে, তাদের সবার সন্তান এখানে ভর্তি হচ্ছে। আগের স্কুলটা এখান থেকে অনেক দূরে পড়ে গেছে।’

স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিও বাদ যায়নি। আছে নাওডোবা পদ্মা সেতু স্বাস্থ্য কেন্দ্র। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত দেয়া হয় চিকিৎসাসেবা। সাধারণ কিছু ওষুধও বিনা মূল্যে দিচ্ছেন তারা।

এ বিভাগের আরো খবর