যুদ্ধশিশু শিখা কানাডার উদ্দেশে যখন বাংলাদেশ ছাড়েন, তখন তার বয়স মাত্র চার মাস। এতটুকু বয়সের কোনো স্মৃতি কিংবা উপলব্ধি কারও স্মরণে আসার কথা না, যা তাকে আন্দোলিত করতে পারে।
সেই শিখা বহু দিন পর তার মেয়ে ক্যাটরিনাকে বলেছিলেন, এ দেশটাকে তিনি তার আত্মায় ধারণ করে আছেন। বাংলাদেশেই তার শেকড়, এটাই তার স্বপ্ন।
দেশ ছাড়ার চার দশক পর বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে শিখার হয়ে কথাগুলো বলছিলেন তারই মেয়ে ক্যাটরিনা।
মা-বাবার ভালোবাসার ফসল নয়, দখলদারদের যৌন নির্যাতনে জন্ম শিখার। মা ও মাতৃভূমির স্নেহবঞ্চিত হলেও স্বদেশের প্রতি তার প্রবল মমত্বের কথা উঠে এসেছিল তারই মেয়ের কথায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভধারণ করেন অনেক নারী। তাদের অনেকেই পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন আর তৎকালীন সমাজের বিরূপ দৃষ্টির সামনে মানসিকভাবে এতটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, সন্তান লালন-পালনের মতো অবস্থায় তারা ছিলেন না।
এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে কানাডার সমাজকর্মী বনি কাপুচিনো ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন এর পক্ষ থেকে ঢাকায় এসে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়ার আয়োজন করেন। তিনি ও তার সহকর্মীরা সে বছরের ১৯ জুলাই পুরান ঢাকার ইসলামপুরে গড়ে তোলা মাদার তেরেসার ‘মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’ থেকে শিখাসহ ১৫ যুদ্ধশিশুকে নিয়ে কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
পরবর্তী সময়ে এই পথ অনুসরণ করেই যুদ্ধশিশুদের কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করা শুরু হয়।
একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের মাতৃসমা সেই বনি কাপুচিনোর সঙ্গে ২০১৫ সালের ২০ নভেম্বর এক আলাপচারিতার আয়োজন করেছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। সেখানে তারই সঙ্গে হাজির ছিলেন শিখার মেয়ে ক্যাটরিনা।
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার নারী এবং এর ফলে জন্ম নেওয়া শিখার মতো শিশুদের পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মমতাময়ী মাতা তেরেসা ও তার সংগঠন মিশনারিজ অব চ্যারিটিজের সদস্যরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর ২১ ডিসেম্বর মাদার তেরেসা প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন। দেখা করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে। রাষ্ট্রপতি তাকে ধর্ষণের শিকার নারী ও ধর্ষণের ফলে জন্ম নেয়া শিশুদের পুনর্বাসনে সরকারকে সহযোগিতার অনুরোধ জানান।
এর কয়েক সপ্তাহ পর বাহাত্তর সালের জানুয়ারি মাসে পুরান ঢাকার ইসলামপুর রোডের ২৬ নম্বর ভবনে চালু হয় মিশনারিজ অফ চ্যারিটির ঢাকা শাখা। পরবর্তী সময়ে মিশনারিজ অফ চ্যারিটির সদস্যদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ও সরকারের শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বনি কাপুচিনোর ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন সহ কানাডার দুটি সংগঠন প্রথমবারের মতো যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়া ও পুনর্বাসনের কাজে এগিয়ে আসে।
এ বিষয়ে মুস্তফা চৌধুরী রচিত ’৭১-এর যুদ্ধশিশু: অবিদিত ইতিহাস বইতে বলা হয়েছে, একাত্তরে ধর্ষণের শিকার অনেক নারীকে স্বামী পরিত্যক্তা হতে হয়েছিল। তখন সেসব গর্ভবতী নারীদের ঠিকানা ছিল এই শিশু ভবন। সেখানে নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে সন্তান জন্ম দিয়ে মায়েরা চলে যেতেন। সিস্টারদের হাতে লালন-পালন হতো অপুষ্টির শিকার এসব শিশু। পছন্দমতো নাম রাখতেন তারাই। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও অধিক সংখ্যক দুষ্প্রাপ্য ঐতিহাসিক নথিপত্র ও দলিল এখনও সংরক্ষিত রয়েছে মাদার তেরেসা হোমে।
প্রতিষ্ঠানটি নানা রকম দাতব্য কাজ করে থাকে। তার একটি দুস্থদের খাদ্য সহায়তা।
মঙ্গলবার দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি কাপড়ের বাজার ইসলামপুরের ভিড় ঠেলে শিশু ভবনের ফটকে পৌঁছে দেখা গেল, দরজার কাছে অনেক সাহায্যপ্রার্থী নারীর ভিড়। তাদের অনেকের হাতে একটি করে কার্ড। এই কার্ড দেখিয়ে তারা শিশুটির জন্য দুধ সংগ্রহ করতে এসেছেন।
ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, তিন তলা ভবনটির নিচের অংশে কুষ্ঠরোগীদের মধ্যে বিতরণের জন্য চাল-ডাল-তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের ব্যাগ তৈরি করে রাখা। সেখানে একটি কক্ষে কথা হয় এই শাখার প্রধান পরিচালিকা সিস্টার জেভিয়ারের সঙ্গে। মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ১৯৭৫ সালে ভারতের কেরালা থেকে মিশনারিজ অব চ্যারিটির ঢাকা শাখায় যোগদান করেন।
কাগজপত্র ঘেঁটে সিস্টার জেভিয়ার জানালেন, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে এখান থেকে মোট ৫৪৯টি যুদ্ধশিশুকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দত্তক দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া এখনও অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের শিকার অনেক মা তাদের সন্তান এখানে রেখে যান। এ রকম শিশুসহ এই মুহূর্তে তারা ৪৫টি শিশু লালন-পালন করছেন। এর বাইরে সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের লেখাপড়া, চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম তারা চালু রেখেছেন।
সিস্টার জেভিয়ার বলেন, যুদ্ধশিশুদের লালন-পালনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পর নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য মিশনারিজ অফ চ্যারিটি ‘জাগরণী’ নামে একটি প্রকল্প চালু করে, যা তিন বছরের বেশি সময় চালু ছিল। এর মাধ্যমে বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের আর্থিকভাবে সাহায্য করার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা হয়।