একাত্তরের পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা ও বানোয়াট বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে মাঠে নেমেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়।’
১৮ মিনিটের ভাষণে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘জাতির পিতা ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার না করতে। কিন্তু পরাজিত শক্তির দোসররা দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে।’
এদেশে ধর্মীয় বিভেদকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। বলেন, ‘ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার করবেন না। প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- সকল ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে।
‘এ দেশে ধর্মের নামে আমরা কোনো ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেব না। ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে এ দেশের মানুষ প্রগতি, অগ্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।’
ভাষণে, ইসলাম ধর্মের প্রসারে জাতির পিতার ভূমিকা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘তার মতো আর কে বাংলার মানুষের মন-মনন-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারত!
‘তাই তিনি যখন সংবিধান রচনা করেন, তখন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চারটি মৌলিক বিষয়কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেন।’
'৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী রাজনীতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পদক্ষেপ নেয় বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘সামরিক জান্তা সঙ্গীনের খোঁচায় সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধারাবাহিক অপপ্রচার চালিয়ে, ইতিহাস বিকৃত করে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কালিমা লেপনের চেষ্টা করে।
‘ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী জাতির পিতা ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষা এবং প্রসারে যা করেছেন, ইসলামের নামে মুখোশধারী সরকারগুলো তা কখনই করেনি। আইন করে মদ-জুয়া-ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা, মাদ্রাসা বোর্ড স্থাপন, ওআইসি’র সদস্যপদ অর্জনের মত কাজগুলো বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই বাস্তবায়িত হয়েছিল।’
স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিজয় উদযাপনের আহ্বান
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে উঠে আসে করোনা প্রসঙ্গও। বিজয় উদযাপনেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে দেশবাসীকে আহ্বান জানান সরকার প্রধান। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের জীবনই মহা মূল্যবান। কোনো অবহেলায় একজন মানুষেরও মৃত্যু কাম্য নয়।
‘তাই, আমি সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিজয় দিবস উদ্যাপনসহ যাবতীয় কাজকর্ম সম্পন্ন করার অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনারা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরিধান করবেন এবং মাঝেমধ্যে হাত সাবান অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করবেন। আপনার সুরক্ষা, সকলের জন্য রক্ষাকবচ।’
সরকারের নানা পদক্ষেপে করোনা মহামারির মধ্যেও দেশের অর্থনীতির সচল আছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারি স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনীতির উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ব অর্থনীতি এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। করোনাভাইরাসের মহামারির ফলে অনেক উন্নত এবং উদীয়মান অর্থনীতির দেশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশে আমরা সময়োচিত পদক্ষেপ এবং কর্মসূচি গ্রহণ করে এই নেতিবাচক অভিঘাত কিছুটা হলেও সামাল দিতে সক্ষম হয়েছি।
‘আমরা প্রায় এক লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি যা জিডিপির ৪.৩ শতাংশ। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রায় ২.৫ কোটি প্রান্তিক মানুষকে নগদসহ নানা সহায়তা দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে আমাদের প্রবাসী আয়, কৃষি উৎপাদন এবং রপ্তানি বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গত অর্থবছরে ৫.২৪ শতাংশ হারে আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রক্ষেপণ বলছে ২০২০ সালে বাংলাদেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি হবে দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ।’
করোনার মধ্যেও মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়টিও প্রাধান্য পায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের বৃহৎ প্রকল্পগুলোর কাজ পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলছে। আমাদের স্বপ্নের ও গর্বের পদ্মাসেতুর সবগুলো স্প্যান বসানো শেষ। ঢাকায় মেট্রোরেলের কাজ আবার পুর্ণদ্যোমে শুরু হয়েছে।
‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এই মহামারিতে একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলির নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মহাসড়কগুলো চার-লেনে উন্নয়নের কাজও পুরোদমে এগিয়ে চলছে।’
‘ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে কেউ এতটা করেনি’
ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে সরকারের নানা পদক্ষেপ তার ভাষণে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সময় ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার এবং প্রসারে যত কাজ হয়েছে, অতীতে কোনো সরকারই তা করেনি। আমরা ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছি। ৮০টি মডেল মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে।
‘কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছি এবং দাওয়ারে হাদিস পর্যায়কে মাস্টার্স মান দেয়া হয়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছি। প্রতিটি জেলা-উপজেলায় দৃষ্টিনন্দন মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। ইমাম- মোয়াজ্জিনদের সহায়তার জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে দিয়েছি।’
এছাড়া ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সারাদেশে মসজিদভিত্তিক পাঠাগার স্থাপন ও লক্ষাধিক আলেম-ওলামায়ে কেরামের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার কথাও জানান সরকার প্রধান।
‘বাংলাদেশ আর অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর নয়’
বাংলাদেশ এখন আর কারো দয়া বা করুনার উপর নির্ভরশীল নয় বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলতেন ভিক্ষুক জাতিকে কেউ সম্মান করে না। আমরা বাংলাদেশের সেই দুর্নাম ঘুচিয়েছি। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ আজ একটি সমীহের নাম। আজকের বাংলাদেশ আর অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশ নয়। আজকের বাংলাদেশ স্বাবলম্বী বাংলাদেশ।’
একটা সময় ছিল আমাদের উন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগ আসত বিদেশি অনুদান থেকে। আজ বাজেটের ৯৭ ভাগ মেটানো হয় নিজস্ব অর্থায়নে। বাংলাদেশ কারও দয়া বা করুণার উপর নির্ভরশীল নয়।’
প্রধানমন্ত্রী আশা করেন, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়ত দেশে পরিণত হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি।
‘জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। আমরা তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব দেশ ও মানুষ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
দেশবাসীকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিজয় দিবসের প্রাক্কালে তাই আসুন, আবারও আমরা শপথ নেই - আমরা যেন লাখো শহিদের রক্তের ঋণ ভুলে না যাই। আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে না দেই।
‘যুবশক্তি, তরুণ সমাজ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে অনুরোধ, তোমরা তোমাদের পূর্বসূরীদের আত্মোৎসর্গের কথা কখনই ভুলে যেও না। তাদের উপহার দেয়া লাল-সবুজ পতাকার অসম্মান হতে দিও না। যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের বিজয়-নিশান সমুন্নত রাখার শপথ নাও এই বিজয় দিবসে। প্রতিজ্ঞা কর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশকে সোনার বাংলাদেশে পরিণত করবে। তবেই ৩০ লাখ শহিদের আত্মা শান্তি পাবে। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ হবে।’
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে ভাষণ শেষ করেন সরকারপ্রধান।